ডা. মো. তারেক ইমতিয়াজ (জয়)
লিচু মৌসুমী ফল হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হলেও, বেশ কয়েক বছর হলো ভারত ও বাংলাদেশে কিছু এলাকায় শিশু মৃত্যুর কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এই লিচু। সমস্যাটি প্রথম ধরা পড়ে ভারতের বিহারে। প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের বিহারের শিশুরা একটি অজ্ঞাত অসুস্থতায় আক্রান্ত হচ্ছিল। এই অসুস্থতার প্রধান উপসর্গ হঠাৎ বমি হওয়া এবং খিঁচুনি হয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। পরবর্তীতে এসব অসুস্থ শিশুদের প্রায় অর্ধেকই মারা যায়। এমন মৃত্যু নিয়ে ধাঁধায় ছিলেন চিকিৎসকেরাও। রোগের ইতিহাস নিয়ে জানা যায় যে এসব অসুস্থ হওয়া শিশুদের প্রত্যেকেই লিচু খেয়েছিল।
১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে এ ফল খেয়ে রহস্যজনকভাবে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে কমপক্ষে ১০০০ জন শিশু৷ শুধু ভারতেই নয়, লিচু খেয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশেও। ২০১২ সালে দিনাজপুরে ১৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল লিচু খাওয়ার ফলে। ২০১৫ সালে একই কারণে একই জেলাতেই ১১ শিশুর মৃত্যু ঘটে। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল কোনো ভাইরাস অথবা লিচু গাছে ব্যাবহৃত কিটনাশক এজন্য দায়ী। কিন্তু পরবর্তীতে নানা গবেষণায় দেখা যায় যে লিচুতে এমন এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে যার নাম ‘মিথিলিন সাইক্লোপ্রোপাইল গ্লাইসিন’ (Methylenecyclopropyl glycine) বা ‘হাইপোগ্লাইসিন’ যা রক্তের গ্লুকোজ কমিয়ে দিতে সক্ষম। সাধারণত খালি পেটে অনেকগুলি লিচু (মূলত আধা-পাকা লিচু) খেলে, লিচুতে থাকা এই হাইপোগ্লাইসিনের প্রভাবে রক্তে থাকা গ্লুকোজের পরিমাণ হঠাৎ কমে গিয়ে শিশুদের বমি, খিঁচুনি শুরু হতে পারে। শিশু অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। এমনকি শিশু মারাও যেতে পারে। তবে যে সব বাচ্চা অপুষ্টিতে ভোগে কিংবা আগের রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিল অর্থাৎ যাদের শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা আগে থেকেই কিছুটা কম ছিল, তারা যদি অপরিপক্ক লিচু একসাথে অনেকগুলো খেয়ে ফেলে তাদের ক্ষেত্রে এটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
মনে রাখতে হবে, কোনো শিশু যদি এরকম অসুস্থ হয়ে যায়, তাহলে সাথে সাথে চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে হবে। রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা যদি কমে যায় তাহলে শরীরে দ্রুত গ্লুকোজ প্রতিস্থাপন করতে হবে, খিঁচুনি হলে খিঁচুনি বন্ধের ঔষধ দিতে হবে এবং শরীরে লবণ ও পানির ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্য কোনো কারণে শিশু অসুস্থ হলো কিনা সেটাও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে খতিয়ে দেখতে হবে।
তবে একটু সতর্কতা অবলম্বন করলে বিপদমুক্ত থাকা সম্ভব। যেমন- খালি পেটে লিচু, বিশেষ করে অপরিপক্ক লিচু খাওয়া যাবে না। শিশুদের খালিপেটে লিচু খেতে নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং বড়দেরও খালিপেটে লিচু না খাওয়াই ভালো। শিশুদের খেতে দেওয়া লিচুর সংখ্যা যাতে একত্রে অনেক বেশি না হয়, সেটির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। একটু সচেতনতা আমাদের প্রিয়জনকে সুস্থ এবং বিপদমুক্ত রাখতে পারে।
[লেখক: এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য); সহকারী রেজিস্ট্রার, শিশু কার্ডিওলজি বিভাগ, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।]