কালান্তরের ধুমকেতু: নজরুলের প্রতিভা ও ট্র্যাজেডি

কালান্তরের ধুমকেতু: নজরুলের প্রতিভা ও ট্র্যাজেডি

অবিভক্ত বাংলার প্রান্তিক ও প্রত্যন্ত জনপদ চুরুলিয়া গ্রামের আক্ষরিক অর্থেই একটি মাটির ঘরে যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল এবং দুঃখ, দারিদ্র্য ও কঠিন জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাহিত্যসাধনার সকল শাখায় তুঙ্গস্পর্শী সাফল্য ও জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত বেদনার নির্বাক জীবন-যাপন শেষে দুখুমিয়া নামের শিশুটি এখন ঘুমিয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় মসজিদের পাশে-তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর জন্ম ছিল একটি নিদ্রিত জাতির মধ্যে মহাজাগরণের ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রবল উত্থানে প্রকম্পিত। নজরুল নিজের একটি গানে যেন সে আবহের জানান দিচ্ছেন:
বাজল কি রে ভোরের সানাই নিদ মহলার আঁধারপুরে,
শুনছি আজান গগন তলে অতীত রাতের মিনার চূড়ে।

নজরুল বিশেষজ্ঞ ড. রফিকুল ইসলাম ‘সৃষ্টির ভুবনে নজরুল স্বাধীন সম্রাট’ প্রবন্ধে (দেশ, ১২ জুন ১৯৯৯) লিখেছেন:
“ফজরের আজানে ‘নিদ্রা অপেক্ষা প্রার্থনা (নামাজ) শ্রেয়’ এই কথা বলা হয়ে থাকে অর্থাৎ জাগরণের আহ্বান থাকে। বাঙালি মুসলমান সমাজে নজরুল ইসলামের জন্ম বাঙালি মুসলমান সমাজের জাগরণের সূচক।”
শতবর্ষ আগে, একই বছরে (১৮৯৯), একই দেশে, একই ভাষার পরিমন্ডলে, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে জন্ম নেন নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশ। তবু নজরুল ও জীবনানন্দ কবিতায় সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হলেন কী করে? শুধু পরিবেশের ভিন্নতা? পরিবেশ, ধর্ম, সংস্কৃতি, চিন্তা, দর্শন, জীবনবোধ কিংবা প্রতিভার রহস্যময়তায় এ ভিন্নতা চি‎হ্নিত করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও নজরুলে বৈশিষ্ট্যগত সুস্পষ্ট পার্থক্য কারও কাছেই অনুভব ও বিবেচনার বাইরে থাকে না। সব কিছুকে ছাপিয়ে রুদ্র কাল বোশেখীর মতো দুর্দান্ড প্রতাপে নজরুল এক ও অনন্য একটি বিশাল ধূমকেতু হয়ে সমগ্র বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে, এমন কি সমাজ-সংসার আর রাজনৈতিক ইতিহাসকে পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে যান। মৃত্তিকালগ্নী গৃহ থেকে মহাকাশের ধূমকেতুর অস্তিত্বে মহাকালব্যাপী প্রসারিত হওয়া নজরুলের পক্ষেই সম্ভব; যদিও এমন ঘটনা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি বা বিশ্ব ইতিহাসেও অসম্ভব।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘দুই কবি: দুই বিপরীত মেরুর প্রতিভূ’ প্রবন্ধে (দেশ, ১২ জুন ১৯৯৯) বলছেন:
“প্রতিভার বিচারে নজরুল অনেক বেশি উজ্জ্বল। তাঁকে রীতিমতন প্রডিজি বলা যেতে পারে। মাত্র বারো-তেরো বছর বয়সে বালক নজরুল লেটোর দলের জন্য গান ও পালা রচনা করতেন। অত কম বয়স, ক্লাস সিক্স পর্যন্ত বিদ্যে, তাঁর গান ও পালার জন্য পয়সা পযন্ত পেতেন, এটা বিস্ময়কর নয়! প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের মক্তবে, মসজিদ সংলগ্ন পরিবারের সন্তান, তাঁদের ব্যবহারিক ভাষাকে বলা হত “মুসলমানি বাংলা’, তাতে আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ ছিল স্বাভাবিক, তবু ওই অবস্থাতেই নজরুল বাংলা কবিতার ছন্দ-মিল আয়ত্ত করেছিলেন, এমন কি ইংরেজি শব্দও ইচ্ছে মতন ঢুকিয়েছিলেন।”
প্রতিভার সঙ্গে নজরুলের ছিল সাহসী ও বিদ্রোহী মন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একই প্রবন্ধে জানিয়েছেন: “সৈন্যদলে যোগ দিতে পাড়ি দিলেন করাচি। তাঁর সহপাঠী বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সৈন্যবাহিনীতে যেতে পারেন নি, হিন্দু মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসিকতায় তাঁর পারিবারিক বাধা ছিল, কিন্তু নজরুলসেই মানসিকতা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।”

নজরুলেরদৃপ্ত মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় করাচি সেনানিবাসে রচিত ‘বাঁধন হারা’য়:
আগুন, ঝড়, ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র, আঘাত, বেদনা-এই অষ্টধাতু দিয়ে আমার জীবন তৈরি হচ্ছে, যা হবে দুর্ভেদ্য, মৃত্যুঞ্জয়, অবিনাশী। আমার পথ শাশ্বত সত্যের পথ, বিশ্বমানবের জনম জনম ধরে চাওয়া পথ, আমি আমার আমিত্বকে এ পথ থেকে মুখ ফেরাতে দেবো না।
এমনই প্রবল বিদ্রোহ ও তীব্র সাহসে নজরুল ছিন্ন করেন তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের সাংস্কৃতিক দাসত্ব এবং রাজনৈতিক পরাধীনতার শৃঙ্খল। নিম্নবর্গের মেহনতি মানুষ ও স্বজাতির আত্মজাগরণের মূলস্রোতে তিনি কবিতা, গান, লোকনাট্য, কথাশিল্পকে বেগবতীভাবে প্রবাহিত করে পরিণত হন জাতির স্বপ্ন ও আকাঙক্ষার সাহিত্য স্রষ্টায়। দীর্ঘ জীবনের মাত্র সামান্য কিছু কর্মময় কালেই তিনি তুলনায় ছাড়িয়ে যান আর সবাইকে; পরিণত হন নিজেই নিজের অনন্য উপমায়। আজকের বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও স্বপ্ন, বাঙালি মুসলমানের স্বাধীনতা ও সংগ্রামশীলতা, সর্বপরাধীনতা থেকে রাষ্ট্র ও মানুষের সাংস্কৃতিক-আত্মিক-রাজনৈতিক মুক্তির কথা আমাদের কাছে, আমাদের জন্য, নজরুল ছাড়া আর কেউ এতো সাহসের সঙ্গে স্পষ্টভাবে বলতে পারেন নি; নজরুল ভিন্ন আর কেউই তা-ই আজকের বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জাতিসত্ত্বার এতোটা কাছে এসে স্বজনের সহৃদয়তায় দাঁড়াতে পারেন নি; নজরুল ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশের জাতীয় কবির স্বীকৃতি দাবি বা প্রত্যাশাও করতে পারেন নি। ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও জীবনবোধে নজরুল যতটুকু আমাদের, আর কেউ ততটুকু আমাদের হতে পারেন নি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির আর সকলের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনায় আমাদের সঙ্গে নজরুলের সর্বাঙ্গীন সম্পর্ক, নিবিড় ঘনিষ্টতা, ঐতিহ্যবাহিত উত্তরাধিকার এবং আত্মা ও শরীরের একাত্মতাই প্রথম আর প্রধান সত্য।

২.
নজরুল বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সে। ছিলেন মাত্র দুই বছর। সেখানেই তাঁর আনুষ্ঠানিক সাহিত্যজীবনের সূচনা। করাচি থেকে ডাকযোগে তিনি কলকাতার পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকেন। পত্র-পত্রিকার সংখ্যা তখন খুব বেশি ছিল না। তবে যেটা খুব বেশি ছিল, তা হলো প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলোতে লেখা ছাপানোর ক্ষেত্রে জাত, পাত, ধর্ম-বিশ্বাসের বিবেচনাকে এবং অনুগত-বশংবদদের সামনে আনার সম্পাদকীয় প্রবণতা। (এখনও এই অন্ধত্ব, মূর্খতা ও আদিম গোত্রীয় মনোভাব লুপ্ত হয় নি!) সে সময়ের প্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্যচর্চা মুসলমানদের জন্য সাদর ও প্রীতিপূর্ণ ছিল না। সাহায্যকারীর চেয়ে বিরোধীর সংখ্যা ছিল অধিক। সকল ক্ষুদ্রতাকে পদানত করে নজরুল অবিরাম লিখতে থাকেন এবং পত্রিকাগুলোও সেসব ছাপাতে বাধ্য হয়। মাত্র কুড়ি বছর বয়সের মধ্যে তাঁর অনেকগুলো গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ছাপা হয়ে যায়। দুটি পত্রিকা তাঁর রচনা প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। একটি ‘মাসিক সওগাত’ আর অন্যটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’।
যুদ্ধ শেষে নজরুল করাচি-পর্ব শেষে সব কিছু নিয়ে কলকাতায় এসে উঠলেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। সেই একুশ বছর বয়সেই তাঁর লেখার যথেষ্ট চাহিদা। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর উপন্যাস ‘বাঁধন হারা’। এরপর কলকাতায় তাঁর ঠিকানা হলো তালতলা এলাকার ভাড়া বাসা-নজরুলের স্মৃতির স্পর্শে যা ঐতিহাসিক মর্যাদায় ভূষিত। কারণ এখানেই তিনি মাত্র একুশ-বাইশ বৎসর বয়সে এক রাত্রির মধ্যে নজরুল লিখে ফেলেন ‘বিদ্রোহী’ নামের একটি দীর্ঘ এবং ঐতিহাসিক কবিতা।

প্রায় একটি অবিশ্বাস্য, অলৌকিক কান্ড। এ কী শব্দ নির্মিত কবিতা, না অনাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিজয়ীর কামান! অবদমিত, ষড়যন্ত্র ও হিংসায় আক্রান্ত, আত্মবিস্মৃতি জাতিকে আগে কেউ বলে নি, ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির’। ঘুমন্ত, বিভ্রান্ত, পথভোলা জাতি নজরুলের উদাত্ত আহ্বান শুনে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। নজরুলের রাজনৈতিক চেতনা ও বিশ্বাস দ্বিধাহীন ও অকপট। পরাধীনতার চেতনা থেকে মুক্তির জন্য ইংরেজ শাসক ও তাদের দোসরদের কাছে আবেদন নিবেদনের বদলে তেজের সঙ্গে গর্জে উঠেছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা ও জাতির মুক্তির জন্য। এই বিষয়গুলো কিংবা আর্থ-রাজনৈতিক সকল বিষয়ে এত স্পষ্ট ও সোচ্চারভাবে আগে আর কেউ লিখেননি; বলেননি। বাঙালি মুসলমান সমাজকে হৃত গৌরবের স্বাধীনতার পথে জাগিয়ে দিতে সেই সময়ে এই রকম একজন সাংস্কৃতিক নেতার প্রয়োজন ছিল। বাঙালি হিন্দু সমাজ রামমোহনকে পেয়েছিলেন, বঙ্কিমকে পেয়েছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র, মাইকেল, এমন কি রবীন্দ্রনাথকেও। কলকাতাকেন্দ্রীক নবজাগরণে বাঙালি হিন্দু সমাজ জেগে উঠেছিল ধর্ম, দর্শন, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বিশিষ্টতায় ও চৈতন্যে। তাঁদের সেই সাফল্য তো বাঙালি মুসলমানকে স্পর্শ করে নি। হায়! তখন পর্যন্ত বাঙালিত্বের পুরোধা হিন্দু সমাজ এটাই ঠিক করতে পারে নি যে, মুসলমানদেরকে বাঙালিরূপে গ্রাহ্য করা যায় কিনা! অগ্রসর বাঙালি হিন্দু সমাজ, তাঁদের ধ্রুবতারারা, এমন কি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যা পারেন নি, সেটা করলেন নজরুল? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সূত্রে জানাই:
রবীন্দ্রনাথ বা অন্যান্য কবিরা যা পারেন নি, নজরুল সরাসরি পৌঁছে গেছেন জনগণের কাছে। রবীন্দ্রনাথ খুবই রাজনীতি ও সমাজ সচেতন ছিলেন, কিন্তু সেসব বিষয়ে তিনি লিখেছেন নিজস্ব ভাষায়, যা আম জনতার ভাষা নয়। কিন্তু তাঁর সমসাময়িক এবং পরবর্তী বেশিরভাগ লেখকের মধ্যেই এই সচেতনতা বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত। জীবনানন্দ দাশের কোনও লেখা পড়ে বোঝারই উপায় নেই যে দেশটা পরাধীন। কবি বা ঔপন্যাসিক বা সঙ্গীতকার বা সাংবাদিক বা স্বদেশচিন্তকগণের মধ্যে সমকালে একমাত্র ইংরেজের জেল খেটেছেন নজরুল।

৩.
নজরুলের সাহিত্যজীবন মোটামুটি মাত্র ২২ বছর। তার মধ্যেও প্রথম দশ বছরেই তিনি তাঁর অধিকাংশ বিখ্যাত রচনাগুলো লিখে ফেলেন। গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার পর তিনি হয়ে ওঠেন গীতিকার ও সুরকার। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে যত গান লিখেছেন, নজরুল মাত্র আট-দশ বছরের মধ্যে সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন তারচেয়ে বেশি। নজরুলের গানের সংখ্যা তিন হাজারের কাছাকাছি! ‘ধুমকেতু’ পত্রিকাকে অবলম্বন করে নজরুল অনেক কাজ করেছেন। ‘ধুমকেতু’ নামে কবিতাও লিখেছেন। ধুমকেতু শব্দটি তাঁর অতি প্রিয় ছিল। নিজেকে ধুমকেতুর সঙ্গে তুলনা দিতে ভালোবাসতেন তিনি। অকালে রুদ্ধ হয়ে লেখালেখি বন্ধ করতে হয়েছিল তাঁকে। চরম অসুস্থ হওয়ার অনেক আগেই তিনি কবিতা রচনা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন; কখনও লিখেও ছিড়ে ফেলেছেন। ১৯৩৬ সালে জসীমউদ্দীনকে একটি চিঠিতে লিখেছেন: “আমি সাহিত্যলোক থেকে যাবজ্জীবন নির্বাসন দন্ড গ্রহণ করেছি।”
নজরুল কী নিজেই জানতেন লেখালেখির জগৎ থেকে তাঁকে বিদায় নিতে হবে? কেন এই বিদায়, তা তিনি বলে যান নি। ১৯২৯ সালে আজিজুল হাকিমকে একটি চিঠিতে কেবল আভাস দিয়েছেন: “আমি এসেছি হঠাৎ ধুমকেতুর মত, হয়ত চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল।” কাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলেন তিনি? তারা কী জানে, কেন নজরুলকে অসময়ে রুদ্ধ হয়ে যেতে হলো?

‘জলপ্রপাতের অন্তর্লীন বিষাদ’ শীর্ষক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে:
১৯৪৩ সালে নজরুল ও তাঁর পরিবারকে সাহায্য করতে একটি প্রকাশ্য কমিটি হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। সম্পাদক সজনীকান্ত দাশ। ১৯৫২ সালে নজরুল নিরাময় সমিতি গঠিত হয়। এই সমিতি কবিকে প্রথমে চারমাস রাঁচিতে রেখে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে দেখান। তারপর তাঁকে ইউরোপ পাঠানো হয় ১৯৫৩ সালের মে মাসে। দেশে ও বিদেশে তাঁকে চিকিৎসার সময় বিধানচন্দ্র (পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী, কংগ্রেস নেতা) কবিকে আগাগোড়াই ডাক্তার হিসাবে দেখেন। বিধানচন্দ্র ভিয়েনা গিয়েছিলেন তখন। সেখানেও তিনি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নজরুলের চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র ও রিপোর্ট নিয়ে কথা বলেন। ততদিনে কবির আরোগ্য লাভের সব রাস্তা ফুরিয়ে গেছে।

নজরুলের সংবিৎহারা অবস্থার আগে বা পরে নজরুলকে নিয়ে যা কিছু করা হয়েছে তার সঙ্গে নজরুলের কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু এ কথাটিই চিরসত্য যে, কোনও অবস্থাতেই তিনি দখলদার ইংরেজ সরকারের তাবেদারি করেন নি; সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পান্ডাদেরকে সমঝে চলেন নি; প্রতিষ্ঠিত গোত্র বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর পক্ষপুটে আশ্রয় নেন নি। শুরু থেকে শেষতক পযন্ত তিনি স্বজাতির কবি ছিলেন; মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক ছিলেন; জাত-পাত-ক্ষুদ্রতার বিরোধী ও বিনাশী ছিলেন। ইতিহাসকার বিপিন পালও স্বীকার করেছেন যে, “নজরুলের শিকড় ছিল দেশজ সংস্কৃতির মাটিতে।” সেই দেশটিই আজকের বাংলাদেশ।
ঐতিহাসিক লাডলীমোহন রায়চৌধুরী ‘সাম্যবাদী আদর্শ প্রচারে অন্যতম পথিকৃৎ-কবি’ শিরোনামে লিখিত এক গবেষণায় জানাচ্ছেন:

কলকাতার হরফ প্রকাশনী নজরুলের যে গানের সঙ্কলন গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিল তার এক জায়গায় লেখা আছে যে নজরুল নাকি শোকে-তাপে এমনই ভেঙে পড়েছিলেন যে শেষের দিকে তিনি স্বীকার করে যান যে আল্লাহ ছাড়া তাঁর জীবনে কামনা করার আর কিছুই নেই। এই উক্তির মধ্যে তাঁর জীবনের দুঃখ বিড়ম্বিত অশান্তমনের অবস্থা ব্যক্ত হয়েছে। জীবনের শুরুতে তিনি নিজের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে যাই পদচি‎হ্ন’। আর জীবন সায়া‎হ্নে এসে সেই একই মানুষ নানা ধরনের শ্যামাসঙ্গীত গানের পালা শেষ করে কবুল করলেন যে আল্লাহ ছাড়া তাঁর আর কিছু চাইবার নেই।
কালান্তরের ধুমকেতুর মতো নজরুলের প্রতিভা আর নজরুলের ট্র্যাজেডি সমগ্র বাংলা সাহিত্যকে ঘিরে রেখেছে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *