চট্টগ্রাম সংবাদদাতা: বিগত বছরগুলোতে দেশের সমুদ্রে থেকে মৎস্য আহরণ ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও সমাপ্ত অর্থবছরে কমেছে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের আহরণ। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৭ লাখ ৩৪ হাজার ৫৯৪ টন মাছ সমুদ্র থেকে আহরণ করা হলেও সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাছের আহরণ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ১৯ হাজার ৬১৯ টন বা ১৪ হাজার ৯৭৫ টন কম। মূলত চোরাই নৌযান নিয়ন্ত্রণ, চাহিদা অনুযায়ী মাছের আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ মাছ আহরণ বাড়ানো পরিকল্পনার কারণে মাছের আহরণ কিছুটা কমেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া নৌযানগুলোকে নজরদারির মধ্যে রাখা জরুরি। এই নৌযানের মৎস্য আহরণের জন্য ট্রাকিং সিস্টেম এবং ফিস ল্যান্ডিং সেন্টার নির্মাণ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করলে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সামুদ্রিক মৎস্য অধিদফতরের আওতায় বর্তমানে সমুদ্রে মৎস্য আহরণে নিবন্ধিত বাণিজ্যিক ট্রলার রয়েছে ২৬৩টি। যদিও গত বছর এই সময়ে নিবন্ধন ছিল ২৩১টি জাহাজের। নিবন্ধন থাকা বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর বেশিরভাগই ফিশিংয়ে নিয়োজিত। বাণিজ্যিক নৌযানের মধ্যে রয়েছে চিংড়ি ট্রলার, ট্রায়াল ট্রিপ বটম, মিডওয়াটার রূপান্তরিত ট্রলার বটম ট্রলার ও মিডওয়াটার ট্রলার। সমুদ্রের যান্ত্রিক (ইঞ্জিনচালিত ও ইঞ্জিনবিহীন) নৌযানের অনুমোদন আছে প্রায় ৬৬ হাজার। বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর মধ্যে কাঠের তৈরি নৌযানের মৎস্য আহরণ ক্ষমতা ৪৫ থেকে ৫০ টন এবং স্টিল বডির জাহাজগুলোর ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ৪০০ থেকে ৪৫০ টন।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, সমুদ্র মৎস্য আহরণে সামুদ্রিক মৎস্য অধিদফতরের বিভিন্ন আইনকানুন আছে। এর মধ্যে সমুদ্রের সীমানা অনুযায়ী কীভাবে কোন জাহাজগুলো মাছ শিকার করতে পারবে সেগুলো মানা হচ্ছে না। তবে সমুদ্রে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন জেলেরা যাতে তাদের চাল বরাদ্দসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সঠিকভাবে পান তার জন্য মৎস্য অধিদফতরকে আরও নজর রাখতে হবে। তাছাড়া সমুদ্রে অনিবন্ধিত নৌযানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। যার কারণে মৎস্য অধিদফতরের কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্প দ্রুত গতিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। এই প্রকল্পটি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে সামুদ্রিক মৎস্যখাতের ব্যাপক পরিবর্তন হবে। ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর নতুনভাবে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বৃদ্ধির এবং পূর্ণাঙ্গ মাছের উৎপাদন বাড়ার জন্য বছরে ৬৫ দিন ও ২২ দিনের দুইবার মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে মাছের আকৃতি ও ওজনের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাণিজ্যিক জাহাজ এবং আর্টিস্যনাল নৌযানের মাধ্যমে সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ হয়েছে ৭ লাখ ১৯ হাজার ৬১৯ টন। যার মধ্যে বাণিজ্যিক জাহাজে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭ টন এবং আর্টিস্যনাল নৌযানের মাধ্যমে আহরিত হয়। ৫ লাখ ৭৩ হাজার ২৪৯ টন। যেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৭ লাখ ৩৪ হাজার ৫৯৪ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫ হাজার ৮৭১ টন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ লাখ ৮৯ হাজার ১০৪ টন। এ ছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ লাখ ৫৯ হাজার ৯১১ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮৭ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৪৭৬ টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬ লাখ ২৬ হাজার ৫২৮ টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৮৪৬ টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮৫ টন, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৭ হাজার ২৮১ টন সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ করা হয়েছিল। অর্থাৎ গত ১৪ বছরে মৎস্য আহরণ বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। সমাপ্ত অর্থবছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সমুদ্র থেকে ইলিশ আহরণ হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ৯২৮ টন, সার্ডিন ৫১ হাজার ৫০০ টন, বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি ৪৬ হাজার ৭৬৩ টন, টুনা ও টুনা জাতীয় মাছ ১৫ হাজার ৫১ টন, লইট্টা ৮১ হাজার ৯৪২ টন, লাক্ষা ২০০ টন, পোয়া মাছ ৪২ হাজার ৭৫৪ টন, চাঁন্দা মাছ ১২ হাজার ৫২ টন, ক্যাট ফিস ১৫ হাজার ৩০৫ টন, হাঙ্গর ও শাপলা পাতা জাতীয় মাছ ৩ হাজার ৩৫১ টন এবং অন্যান্য মাছ আহরণ হয়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার ৭৭৩ টন।
এদিকে সমাপ্ত অর্থবছরে সমুদ্র থেকে ইলিশ মাছ আহরণ হয়েছিল ৩ লাখ ২০ হাজার ৯২৮ টন। কিন্তু গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ইলিশের আহরণ ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ৮৭১ টন। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ইলিশের আহরণ কমেছে ৯৪৩ টন।