পূর্ব প্রকাশিতের পর
রবীন্দ্রযুগে স্বতন্ত্র সত্যেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বীকৃতি
কবিতায় ছন্দের কারুকাজ, শব্দ ও ভাষা যথোপযুক্ত ব্যবহারের কৃতিত্বের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে ‘ছন্দের যাদুকর’ নামে আখ্যায়িত করেন। তিনি ছিলেন ‘ভারতী’ পত্রিকাগোষ্ঠীর অন্যতম কবি। প্রথম জীবনে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, অক্ষয় কুমার বড়োল প্রমুখের দ্বারা প্রভাবিত হন। পরে রবীন্দ্র অনুসারী হলেও তিনি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন।
বাংলা শব্দের সঙ্গে আরবি-ফার্সি শব্দের সমন্বিত ব্যবহার দ্বারা বাংলা কাব্যভাষার শক্তি বৃদ্ধির প্রাথমিক কৃতিত্ব ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের। অনুবাদের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ ঘটান।
দেশাত্মবোধ, মানবপ্রীতি, ঐতিহ্যচেতনা, শক্তিসাধনা প্রভৃতি তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু। আরবি-ফার্সি, চিনা, জাপানি, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষার বহু কবিতা অনুবাদ করে বাংলাসাহিত্যের বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি সাধন করেন।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা মূলত প্রবাসী ভারতীয় পত্র- বাণী বিচিত্রা, বঙ্গলক্ষী, দেশ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের রচিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো- সবিতা (১৯০০), সন্ধিক্ষণ (১৯০৫), বেণু ও বীণা (১৯০৬), হোমশিখা (১৯০৭)।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন-
‘তুমি বঙ্গভারতীর তন্ত্রী-পরে একটি অপূর্ব তন্ত্র এসেছিলে পরাবার তরে এ শুধু প্রিয়জনের প্রশংসা নয়, এ এক ঐতিহাসিক সত্য।’
প্রখ্যাত সাহিত্যিক, বিজ্ঞানানুরাগী, ইতিহাস প্রেমিক পিতামহ অক্ষয় কুমারের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি সাহিত্যিক প্রতিভা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ও ইতিহাস প্রিয়তা লাভ করেছিলেন। যে যুগে তাঁর আবির্ভাব, সে যুগ ছিল তাঁর মনবিকাশের অনুকূল। এই পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিকদের উত্তরাধিকারী সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বিশেষ করে সে যুগেরই সন্তান হয়ে উঠলেন। তিনি স্বদেশকে ভালোবাসলেন। স্বদেশের দুঃখ-দুর্দশা তাঁর প্রাণে বড়ো গভীর করে বাজল। তিনি উপলব্ধি করলেন মানুষে মানুষে একাত্মবোধ জাগাতে হবে সবার আগে। এর জন্য চাই জ্ঞান আর প্রেম। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন। ভারতবাসীকে তাঁর মহিমা উজ্জ্বল ঐতিহ্য স্মরণ করে দিয়েছেন।
বিশ্বপ্রেমিক, মানবতার পূজারী ও সাম্যবাদী সত্যেন্দ্রনাথ মুক্তকণ্ঠে গেয়ে গেছেন-
‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে সে জাতির নাম মানুষ জাতি’
হিন্দু মুসলমানের বিরোধ তাঁর অন্তরকে ব্যথিত করত। সে যুগের হিন্দু-মুসলিম মিলনকামী মহাপুরুষদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মধ্যে বহুমুখী চৈতন্যের প্রকাশ ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এই প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে বলে-
‘আমি মুক্তকণ্ঠে বিন্দুমাত্র বিনয় প্রকাশ না করে বলিতেছি যে, বাংলা ভাষা ও ছন্দে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের যে অসামান্য অধিকার ছিল তাহা আর-কাহারো সঙ্গে তুলনীয় নহে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে ছন্দের জাদুকর বলার পরে অনেকেই সেটির ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। কবি মোহিতলাল মজুমদার এবং কবি বুদ্ধদেব বসু কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার সমালোচনা করে বলেছেন-
‘তাঁর কবিতায় কেবল শব্দের ঝংকার, কোন প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।’
যদিও বেশিরভাগ সাহিত্য সমালোচকরা মনে করেন, এই সমালোচনা কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ক্ষেত্রে যথার্থ নয়।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের যে সমস্ত দেশাত্মবোধক কবিতা, মানবিক কবিতা এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে, কবিতায় যদি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারতেন তাহলে মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও তাঁর কবিতা মানুষের মনে এভাবে দাগ কেটে থেকে যেত না। আর শব্দের ঝংকার কবিতা রচনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ শৈলী। ছন্দের ঝংকারের কারণেই শৈশবে পড়া কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা আজও মনে গেঁথে রয়ে গেছে। যেমন-
‘ছিপখান তিন-দাঁড় তিনজন মাল্লা
চৌপর দিন-ভর দেয় দৌড়-পাল্লা!..’
এই যে ছন্দের দোলা- স্বরবৃত্ত এবং স্বরমাত্রিক ছন্দকে ব্যবহার করার অসাধারণ দক্ষতা, যা আমাদের দৈনন্দিন কর্ম জীবনকে কবিতায় ধারণ করতে পেরেছে। এই জন্য কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মানবিক রচনা, দেশাত্মবোধক কবিতা এবং অনুবাদ সাহিত্য চর্চা জরুরি।
অনুবাদক হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
অনুবাদ সাহিত্যের ক্ষেত্রে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। তিনি বোদলেয়ার অনুবাদ করেছেন, পল ভারলেন অনুবাদ করেছেন, ইংরেজ কবিদের কবিতা অনুবাদ করেছেন। একই সঙ্গে কুরআন শরীফ থেকে অনুবাদ করেছেন, হাদিস নিয়ে অনুবাদ করেছেন। আবার পারস্যের কবিদের কবিতার অনুবাদ করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি কবিতা আমাদের মুখে মুখে ফেরে। যদিও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নিজেই বলেছেন, এই কবিতাটি তিনি হাদিস থেকে রচনা করেছেন।
‘‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি..’
আবার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কুরআনের সূরা ‘আদ দোহা’র অনুবাদ করেছেন। এটি এত ভালো অনুবাদ হয়েছে, যার দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না! সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ করা সুরা আদ দোহা-
‘মধ্যদিনের আলোর দোহাই,
নিশার দোহাই ওরে
প্রভু তোরে ছেড়ে যাননি কভু
ঘৃণা না করেন তোরে।
পথ ভুলেছিলি তিনি সুপথ
দেখায়ে দেছেন তোরে,
সে কৃপার কথা স্মরণে রাখিস;
অসহায় জনে ওরে।’
শুধু তাই নয় ফার্সি ভাষার শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ গুলিস্তানের বিখ্যাত কবি শেখ সাদির কবিতার অনুবাদ করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর অনুবাদের একটি অংশ-
‘কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে পায়,
তা ব’লে কুকুরে কামড়ানো কি রে মানুষের শোভা পায়?’
বিদেশি কবিতার ভাষান্তরে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষার উপর অধিকার বিশেষভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনটি অনুবাদগ্রন্থে পাঁচশোর বেশি কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন। তাঁর কবি স্বভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কবিতার ভাষান্তর আশ্চর্য সাফল্য লাভ করেছে। বাঙালি কবিদের মধ্যে অনুবাদ কর্মকে তাঁর মতো আন্তরিক নিষ্ঠাভরে গ্রহণ করতে খুব বেশি দেখা যায় না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, ‘বিশ্বমানবের নানা বেশ, নানা মূর্তি ও নানাভাবের সহিত পরিচয় সাধন।’
রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, ‘তোমার এই অনুবাদগুলি যেন জন্মান্তর প্রাপ্তি-আত্মা এক দেহ হইতে অন্য দেহে সঞ্চারিত হইয়াছে- ইহা শিল্পকার্য নহে, ইহা সৃষ্টি কার্য।’ তখন তার মধ্যে কোনো অতিশয়োক্তি নেই।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কিছু অনুবাদ হলো- তীর্থ সলীল (১৯০৮), তীর্থ রেণু (১৯১০), ফুলের ফসল (১৯১১)।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছদ্মনাম
নবকুমার, কবিরত্ন, অশীতিপর শর্মা, ত্রিবিক্রম বর্মন, কলমগীর প্রভৃতি ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।
শেষকথা
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত শ্রুতিমধুর সূক্ষ্মতায় ও বিশ্লেষণী বুদ্ধিতে বাংলা কবিতায় কেবল ছন্দ নয়, কবিতার ক্ষেত্রকেও অনেকখানি প্রসারিত করতে পেরেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর এই ঐতিহাসিক ভূমিকাকে সাহিত্য সমালোচকদের স্বীকার না করে কোনো উপায় নেই। তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান পাওয়ার জন্য কবিতা লেখেননি, তিনি কবিতা লিখে বাঙালির হৃদয়ে স্থান পেতে চেয়েছেন।
‘কোন দেশেতে তরুলতা
সকল দেশের চাইতে শ্যামল?
কোন দেশেতে চলতে গেলেই’
এই কবিতা যে কবি লিখতে পারেন, তিনি মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও যে প্রাসঙ্গিক থাকবেন, সে কথা বলাই বাহুল্য।