আসিফুর রহমান সাগর: প্রতিটি দেশ বা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারা রয়েছে। প্রথাগত পরম্পরায় তা বিকশিত হয়। গুরু-শিষ্যপরম্পরায় তা টিকে থাকে। আমাদের রিকশা এবং রিকশা আর্টও সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। সম্প্রতি ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র (রিকশা অ্যান্ড রিকশা পেইন্টিং ইন ঢাকা) ইউনেসকোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। তাই নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে ঢাকার রিকশা ও তাকে সাজিয়ে তোলায় শিল্পীদের বিশেষ ধারার আর্ট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, অনেকেই মনে করছেন শুধু রিকশার পেইন্টিংকে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তা কিন্তু নয়। রিকশা একটি বাহন, যা আমাদের এ অঞ্চলের বিশেষভাবে সমাদৃত এবং মানুষের জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেই রিকশাকে সাজিয়ে তোলার একটা বিশেষ ধারা গড়ে উঠেছে শিল্পীদের দ্বারা। শুধু বিষয়ভিত্তিক ছবি আঁকাই নয়, প্লাস্টিকের সাহায্যে যে অ্যাপ্লিকের কাজ দেখা যায়, এটাও অনন্য। রিকশা আর্টের মধ্যে সেগুলোও অন্তর্ভুক্ত।
জামদানি বয়নশিল্প, শীতলপাটি বয়নশিল্প, বাউল গান ও মঙ্গল শোভাযাত্রার পর প্রায় ছয় বছরের বিরতিতে বাংলাদেশের পঞ্চম অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে ‘ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র’ এ স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ স্বীকৃতির ফলে বিগত আট দশক ধরে চলমান রিকশা চিত্রকর্ম একটি বৈশ্বিক ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেসকোর স্বীকৃতি লাভ করল।
এর আগে, গত ছয় বছর যাবত্ এ চিত্রকর্মের নিবন্ধন ও স্বীকৃতির প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও প্রথম চেষ্টায় তা ব্যর্থ হয়। তবে ২০২২ সালে পুনরায় নথিটি জমাদানের সুযোগ প্রদান করা হলে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ও প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ নথিটি নতুনভাবে প্রস্তুত করা হয়।
বর্ণিল পরিবহন হিসেবে ঢাকায় রিকশার আবির্ভাব ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান দেশভাগের কিছু আগে। এরপর ধীরে ধীরে এ রিকশার শরীরকে ঘিরে শিল্পীদের এই অংকনধারা জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। রিকশার হুড, হ্যান্ডেল, পাদানিতে বিশেষ সজ্জা থাকে। আর রিকশার পেছনে নিচের অংশে ধাতব পাতে উঠে আসে লোকজ উপাদান, শহুরে সাম্প্রতিক বিষয়াবলি এবং অবশ্যই বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গ সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের মুখচ্ছবি। এসবের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবন, প্রাকৃতিক দৃশ্য, হাদিসের লাইন, মানবিক গুণাবলির বাক্যাংশ, স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন, শহিদ মিনার, তাজমহল, সিনেমার দৃশ্য, রাস্তা ও পশুপাখির ছবি রিকশাচিত্রকে অনেক মানুষের কাছে নিয়ে গেছে, বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তুলেছে।
পাকিস্তান আমলে যখন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশে আধুনিক চিত্রকলা যাত্রা শুরু করেছে, প্রায় একই সময়ে শিল্পের অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারাও গড়ে ওঠে এই রিকশার অবয়বকে ঘিরে। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পীতলরাম সুর, আর কে দাস, আলাউদ্দিন, আলী নুর, দাউদ উস্তাদ প্রমুখ শিল্পী। এসব অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীর মাধ্যমেই বিকশিত হয় এ দেশের সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং, রিকশা আর্ট, ট্রাক আর্ট ইত্যাদি। আর এগুলোর মধ্যে যেটি নিজস্ব শিল্পশৈলী, উপস্থাপন রীতি ও বিষয়বস্তুর স্বকীয়তায় ধীরে ধীরে স্থায়ী রূপ নিয়েছে তা হলো রিকশা আর্ট।
পালকির বিকল্প হিসেবে ১৮৬৫-৬৯ প্রথম কে এর উদ্ভাবন করেছিলেন, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। রিকশা তার উৎপত্তি ক্ষেত্র জাপান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। তবুও রিকশার বিস্তৃতি মূলত এশীয় ও পূর্ব-এশীয় দেশগুলোতে বেশি লক্ষ করা যায়। তবে, উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হলো, জোনাথন স্কোবি নামে একজন মার্কিন মিশনারি ১৮৬৯ সালে রিকশা উদ্ভাবন করেন। স্কোবি থাকতেন জাপানের সিমলায়। ১৯০০ সালে কলকাতায় হাতে টানা রিকশা চালু হয়, তবে মালপত্র বহনের জন্য। ১৯১৪ সালে কলকাতা পৌরসভা রিকশায় যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেয়। ততদিনে মিয়ানমারের রেঙ্গুনেও রিকশা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯১৯ সালে রেঙ্গুন থেকে রিকশা আসে চট্টগ্রামে। তবে ঢাকায় রিকশা চট্টগ্রাম থেকে আসেনি; এসেছে কলকাতা থেকে। নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের ইউরোপীয় পাট ব্যবসায়ীরা নিজস্ব ব্যবহারের জন্য কলকাতা থেকে ঢাকায় রিকশা আনেন। রিকশার বহুল ব্যবহার এবং নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী কাঠামোর কারণে ঢাকাকে বিশ্বের রিকশার রাজধানী বলে থাকেন অনেকে।
মূলত রিকশা পেইন্টিংয়ের সূত্রপাত হয় এই সময় থেকেই। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে রিকশা পেইন্টিং তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় হতে থাকে। রিকশা পেইন্টিংয়ের চাহিদা ছিল তখন অনেক বেশি। রিকশা পেইন্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা তাদের অনেকে আগের পেশা বা পৈতৃক পেশা ছেড়ে এই পেশায় যুক্ত হন। যেমন আর কে দাশের পৈতৃক পেশা ছিল চামড়ার কাজ। তিনি ও তার ছেলেরা এসেছেন রিকশা পেইন্টিংয়ের কাজে।
বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে তো বটেই, পৃথিবীর চারুশিল্পের ইতিহাসেও বিশেষ ধরন বা শৈলী হিসেবে রিকশা পেইন্টিং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারার বিলুপ্তি ঘটলে পৃথিবীর শিল্পকলার ইতিহাসের একটা উল্লেখযোগ্য শৈলীর অবসান ঘটবে। তবে আশার কথা, সম্প্রতি ইউনেসকোর এই স্বীকৃতি রিকশা ও রিকশা পেইন্টিংকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে।
শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, মানুষের জীবনের চাহিদা, গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে রিকশারও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সে কারণেই এখন রিকশার বদলে মেশিন রিকশার প্রচলন দেখা যাচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে হয়তো বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে রিকশা কমে আসবে। তবে, একে টিকিয়ে রাখতে হবে। তিনি বলেন, ‘সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের কারণেই ইউনেসকোর এ স্বীকৃতি মিলেছে। এখন একে টিকিয়ে রাখতে হবে আমাদের। রাজধানীর বিশেষ বিশেষ কিছু সড়কে, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাসহ আবাসিক এলাকাগুলোতে, গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পটগুলোতে রিকশাকে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এতে রিকশা যেমন টিকে থাকবে, সেই সঙ্গে টিকে থাকবে রিকশা পেইন্টিংও।
যদিও, রিকশা পেইন্টিং এখন পোশাক ও আসবাবপত্রের শরীরে জায়গা করে নিচ্ছে। এই ধারার পেইন্টিং তরুণদের বিশেষ পছন্দের। এদিকে, তরুণ শিক্ষার্থীরাও রিকশা পেইন্টিংয়ের ধারায় ছবি আঁকছেন ক্যানভাসে। এভাবেই রিকশা ও রিকশা পেইন্টিং হয়তো টিকে থাকবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে