ইসলামি ইতিহাসে রবিউল আওয়াল গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য একটি মাস। ঐতিহাসিক মাস। হিজরি সনের চাকা ঘুরে আবার আমাদের মাঝে উপস্থিত এখন এ মাসটি। রবিউল আওয়াল মাসের চাঁদ আকাশে উঁকি দিতেই বিশ্বময় মুসলমানদের মাঝে নতুন করে এক আন্দোলন শুরু হয়।
হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বত নতুন করে জাগ্রত হয়। কারণ অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতানুসারে এ মাসে সাইয়েদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালিন, খাতামুন নাবিয়্যিন এ ধরাপৃষ্ঠে আগমন করেন, আবার এ মাসের ১লা রবিউল আউয়াল তিনি আল্লাহ্ তায়ালা প্রদত্ত রিসালাতের সব দায়িত্ব পালন শেষে প্রভুর আহ্বানে- সাড়া দিয়ে ওফাত লাভ করেন।
যখনই এ মাসের শুভাগমন হয়, মুসলমানদের অন্তরে স্বাভাবিকভাবে নবি প্রেমের নতুন হাওয়া জাগে, তারা নতুন করে আন্দোলিত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম তারিখ ১২ই রবিউল আউয়াল, সোমবার । আবার এ মাসের ১ তারিখ হযরত রাসুল (সা.) ওফাত লাভ করেছেন।
মহানবি হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-কে ভালোবাসা ও তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুযায়ী জীবনযাপন করা ইমানের অংশ। এ প্রসঙ্গে ইমাম বুখারি (রহ.) তাঁর কিতাবে স্বতন্ত্র একটি শিরোনাম এনেছেন, যার অর্থ ‘নবি করিম (সা.)-এর ভালোবাসা ইমানের অঙ্গ’। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আনাস (রা.) ও হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ওই সত্তার শপথ ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ পরিপূর্ণ ইমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার কাছে নিজ পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষ হতে প্রিয় না হব।’ (বুখারি শরীফ: হাদিস ১৫, মুসলিম শরীফ: হাদিস ৪৫, মুসনাদে আহমদ: ১২৪৩)
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন, হে নবি ! আপনি বলুন, তোমাদের কাছে যদি তোমাদের পিতা-মাতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাইবোন, তোমাদের পত্নী, তোমাদের বংশ, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের এমন ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় করো এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ করো; আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল এবং তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় না হয়, তাহলে অপেক্ষা করো-আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ্ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। (সূরা তাওবা ৯: আয়াত ২৪)
উল্লিখিত আয়াতে গোটা মুসলিম জাতির প্রতি এ আদেশ দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা এমন উন্নত স্তরে রাখা ওয়াজিব, যে স্তরে অন্য কারও ভালোবাসা স্থান পাবে না। তাই যার ভালোবাসা এ স্তরে নেই সে শাস্তির যোগ্য। হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসার অর্থ হযরত রাসুল (সা.)-এর সিরাত আলোচনা করা যেমন পুণ্যের কাজ তেমনিভাবে তাঁর সুরত বা দৈহিক গঠন নিয়ে আলোচনা করাও পুণ্যের কাজ। কিন্তু দৈহিক সুরত নিয়ে আলোচনার মাঝে আমাদের করণীয় কিছু নেই।
শুধু আলোচনার দ্বারা সওয়াব পাওয়া যায়। কারণ শত চেষ্টা করেও আমাদের সুরতকে হযরত রাসুল (সা.)-এর সুরতের মতো করা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে তাঁর সিরাত নিয়ে আলোচনার দ্বারা সওয়াব পাওয়ার পাশাপাশি অনুরূপ চরিত্র গঠনের আশা করা যায়, যা দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি।
সত্যিকারার্থে হযরত রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার অর্থ হলো, তিনি যেসব গুণে গুণান্বিত ছিলেন সেগুলোর চর্চা করা ও নিজের মাঝে সেগুলোর বাস্তবায়ন এবং যেসব বিষয় তিনি পরিহার করেছেন ও পরিহার করতে বলেছেন তা পরিহার করা। এ মর্মে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর আনীত দ্বিনকে তোমরা আঁকড়ে ধর, আর যা নিষেধ করেছেন তা পরিহার করো।’ (সূরা আল হাশর ৫৯: আয়াত ৭)
হযরত রাসুল (সা.)-এর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ আরও বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে যারা পরকালে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে ও আল্লাহ্কে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহ্র রাসূলের মাঝে রয়েছে সর্বোত্তম আদশ।’ (সূরা আল আহযাব ৩৩: আয়াত ২১)
পবিত্র কুরআন ও হাদিসে প্রত্যেকটি বিষয় যেভাবে এসেছে এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে আমল করেছেন বা করতে বলেছেন সেভাবে করা বা মেনে নেওয়ার নামই হলো ইবাদত। এতে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করাকে শরিয়ত সমর্থন করে না। এমনিভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভালোবাসার ব্যাপারে তিনি যেভাবে ভালোবাসতে বলেছেন বা সাহাবায়ে কেরামরা যেভাবে ভালোবাসা দেখিয়েছেন সেভাবে ভালোবাসাই হলো ইবাদত। এতে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করা শরিয়ত সমর্থন করে না।
সাহাবায়ে কেরাম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা হযরত রাসুল (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করেছেন। ভালোবাসার ক্ষেত্রে তাদের মতো সুন্নাতের অনুকরণ ও আদর্শে আদর্শবান হওয়া ইবাদত ও সাওয়াবের কাজ। এ মর্মে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ইমান আন যেমনি ইমান এনেছেন মানুষরা অর্থাৎ সাহাবারা।’ (সূরা বাকারাহ ২: আয়াত ১৩) সুতরাং তাদের ইমান ও আমল অনুযায়ী আমাদের ইমান ও আমল হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাদের ইমান ও আমলের প্রতি আল্লাহ্ তায়ালা খুশি হয়ে বলেন, ‘আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, তারাই আল্লাহর দলের অন্তর্ভুক্ত। জেনে রেখ আল্লাহর দলই সফলকাম হবে’ (সূরা মুজাদালা ৫৮: আয়াত ২২)।
রবিউল আউয়ালের মূল শিক্ষা ও দাবি হলো-জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহর হুকুম ও হযরত রাসুল (সা.)-এর সুন্নাতের অনুসরণ। জগতের সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসাকে নিজের জীবনে ধারণ করা। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের তওফিক দান করুক। আমিন।