মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়: উনিশ শতকে তাঁর প্রতিভার অনন্যতা নিয়ে একক মহিমায় দাঁড়িয়ে আছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আমরা দেশের ও বিদেশের স্বনামখ্যাত মানুষদের জন্মদিন-মৃত্যুদিনে তাঁদের স্মরণ করি। কিন্তু অনেক সময় বিবেচনা করে দেখি না, কেন তাঁরা স্মরণীয়, আর তাঁদের কোন আদর্শ আমাদের নিজেদের জীবনে অনুসরণ করলে আমরা নিজ জীবনকে সার্থক করে তুলতে পারব।
বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন ঔপনিবেশিক ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে আশি কিলোমিটার দূরের বীরসিংহ গ্রামে। দূরত্বটা দুটি দিক দিয়ে সুদূর এক. ভারতবর্ষের ব্যাপ্ত আয়তনে অজ্ঞানধুসর অযুত-নিযুত গ্রামের একটি ছিল সেটি। আর শিক্ষা স্বাস্থ্য নয়, পরিকীর্ণ ছিল দারিদ্র্য ও কুসংস্কারের পাঁকে। সেখান থেকে তাঁর কলকাতায় আগমন, শিক্ষা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাই এক বিস্ময়। প্রায় নিরন্ন হয়ে তিনি ১২ বছর কলকাতার সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন, প্রতিবছর বৃত্তি পেয়ে। কী ছিল শেখার বিষয়? ছিল ব্যাকরণ, কাব্য, অলংকার (মাত্র ষোলো বছরের কিশোর ‘সাহিত্যদর্পণ’-এর পাঠ নিচ্ছেন, তৎসহ ‘কাব্যপ্রকাশ’, অসাধারণ মেধাবী না হলে সম্ভব নয়), স্মৃতি, বেদান্ত, ন্যায়, জ্যোতিষ, ধর্ম। বোঝা গেল কিছু? একুশ বছর বয়সে তিনি এতোগুলি বিষয়ে অনার্স পাশ করেছেন বললে ব্যপারটা খোলসা হবে। হাঁ, ঠিক তাই। এ পর্যায়ে তিনি কবিতা লিখে ১০০ টাকা পুরস্কারও পাচ্ছেন, বার্ষিক বৃত্তি ছাড়া এবং মেধার জোরে ঐ বয়সেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক। পরে আসেন সংস্কৃত কলেজে, অধ্যক্ষ হয়ে। এখানে তিনি যে অসংখ্য পরিবর্তন এনেছিলেন, তার মধ্যে অষ্টমী ও প্রতিপদ তিথির পরিবর্তে রবিবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া আর কেবল ব্রাহ্মণ-বৈদ্য নয়, সমস্ত বর্ণের ছাত্রদের সেখানে শিক্ষা গ্রহণের অধিকার দেওয়া। নবজাগরণের যথার্থ চিহ্ন যদি নিহিত থাকে যুক্তিপরায়ণতায়, তাহলে তিনি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। যিনি তাঁর কলেজে বেদান্তের মতো একটি বিষয়কে তুলে দেবার সাহস দেখিয়েছিলেন। এটি তাঁর কাছে নিতান্ত ভ্রান্ত দর্শনরূপে বিবেচিত হয়েছিল বলে। এটি খুব যুগান্তকারী। নিজ জেলায় জেলায় একক প্রচেষ্টায় মেয়েদের জন্য ৩৭টি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। সেখানকার আর্থিক ব্যয়ভার নিজে বহন করেছেন। তাছাড়া দুর্ভিক্ষের অন্নছত্র খোলা, দুস্থদের জন্য স্থায়ী সাহায্যের বন্দোবস্ত রাখা, যাতে তাঁর মৃত্যুর পরে আর্থিক অসুবিধায় না পড়ে তারা, এসব করে গিয়েছিলেন। মধুসূদনকে অর্থসাহায্য করার কথা আমরা জানি। মধুসূদনের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিরক্ষার জন্য কিন্তু একপয়সাও দেননি। ষাট বছর বয়সে ডাক্তারি শিখছেন, হোমিওপ্যাথি, কঙ্কাল কিনে এনে অ্যানাটমি শিখছেন।
বিজ্ঞান চিন্তাতেও মগ্ন দেখি তাঁকে আমরা। বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর কিশোরপাঠ্য জীবনী লিখেছেন তিনি। এই জ্ঞান কাজে লাগাচ্ছেন শত শত সাওতালদের চিকিৎসক হয়ে যখন তিনি কার্মাটারে তাদের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছেন। মধুসূদন ভুল বলেননি, বিদ্যাসাগরের মধ্যে ছিল প্রাচীন ঋষির প্রজ্ঞা, ইংরেজের কর্মোদ্যম ও বাঙালি মায়ের হৃদয়বৃত্তি। তার মতো নারীবাদী আজও বাংলায় জন্মাননি। মধুসূদন ভুল করেননি বিদ্যাসাগরকে ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য উৎসর্গ করে। তিনি ছিলেন তত্ত¡বোধিনী’র উপদেষ্টা। ব্রাহ্মসমাজের মধ্যমণি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে আপত্তি ছিল না তাঁর, মূলত সাহিত্য নিয়ে কারবার যে-পত্রিকার, যেখানে মুধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ ছাপা হয়। কিন্তু যে- মুহূর্তে পত্রিকাটি ব্রাহ্মধর্মের মূখপত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করল, বিদ্যাসাগর তৎক্ষণাৎ সরে দাঁড়ালেন। এই হলেন বিদ্যাসাগর।
পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে হয়েছিল তাঁকে সেই যুগে, আশি টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়ামে কোষাধ্যক্ষের চাকরি নিতে গিয়ে, ১৮৪৯ সালে। এসব টাকা আসত কোত্থেকে? বিদ্যালয়ের ব্যয়ভার, অন্নছত্র, মধুসূদনকে অর্থের পর অর্থের পর অর্থসাহায্য, একজন দুআড়াইশো টাকার বেতনভুকের পক্ষে সম্ভব? তাও আবার আদর্শগত কারণে একাধিকবার চাকরি ছাড়ছেন যিনি? এখানেই রয়েছেন আর এক বিদ্যাসাগর, হিমশৈলের মতো, ততোটা ঠাহর পাই না যাঁকে। সাতাশ বছর বয়সে তিনি ব্যবসায়ীরূপে আত্মপ্রকাশ করেন ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটারি’ নামে বইয়ের দোকান খুলে। পরে বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে খোলেন প্রকাশনা। সারা জীবনে যা লিখেছেন আর অন্যান্যের লেখা বই ছেপে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। এইক্ষেত্রেও তিনি আমাদের আদর্শ হতে পারেন।