আসআদ শাহীন: ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়কেই জ্ঞান অর্জনের নির্দেশ দিয়েছে; তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) যেমন পুরুষদের ইলম, পবিত্র কুরআন ও ইসলামের বিধি-বিধান শিক্ষা দিতেন, তেমনি নারীদের শিক্ষার প্রতিও বিশেষ নজর দিতেন। এ কারণে পুরুষরা যেমন ফকিহ, মুহাদ্দিস এবং অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যে পারদর্শিতা অর্জন করেছেন, তেমনি নারীরাও বিখ্যাত আলেম, মুহাদ্দিস ও ফকিহ হয়েছেন।
হিজরি প্রথম শতাব্দীর বিখ্যাত নারী ফকিহদের বিষয়ে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করা হলো :
উম্মুল মু’মিনিন আয়েশা (রা.): উম্মুল ম’ুমিনিন আয়েশা (রা.) আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর দুহিতা। মহানবি (সা.)-এর ওফাতের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর। হাদিসে তাঁর অনেক মানাকিব বর্ণিত হয়েছে। তিনি ৫৮ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন এবং জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৪২৬)
আবু মুসা আশআরি (রা.) বলেন, আমরা অর্থাৎ হযরত রাসুল (সা.)-এর সাহাবায়ে কেরাম যখন কোনো হাদিস সম্পর্কে সমস্যায় পড়তাম, তখন হযরত আয়েশা (রা.)-কে সেই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতাম। তিনি তা সমাধান করে দিতেন। (তিরমিজি : কিতাবুল মানাকিব, হাদিস ৩৮৮৩)
উরওয়া বিন জুবায়ের (রা.) বলেন, হযরত আয়েশা (রা.)-এর চেয়ে আইনশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র ও কবিতায় বেশি জ্ঞানসম্পন্ন অন্য কাউকে আমি দেখিনি। (আল ইসতিয়াব ফি মারিফাতিল আসহাব : খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৮৮৩)
মাসরুক (রহ.) বলেন, আমি মহানবি (সা.)-এর বড় সাহাবিদের হযরত আয়েশা (রা.)-কে উত্তরাধিকার (মিরাস) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে দেখেছি। (তাহজিবুত তাহজিব, খণ্ড ১২, পৃষ্ঠা ৩৮৬)
উম্মুল মু’মিনিন উম্মে সালামা (রা.): উম্মুল ম’ুমিনিন উম্মে সালামা (রা.)-এর নাম হিন্দ বিনতে আবি উমাইয়া (রা.)। জাহাবি (রহ.) তাঁকে ফকিহ বলেছেন এবং তাঁর আইনশাস্ত্রে দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা ও তীক্ষ বুদ্ধিমত্তা বহু হাদিস থেকে প্রমাণিত। উদাহরণস্বরূপ, হুদায়বিয়ার শান্তিচুক্তির সময়ে মহানবি (সা.) যখন সাহাবায়ে কেরামকে ওমরাহ না করে ‘হলক’ (মাথা মুণ্ডান)-এর নির্দেশ দেন, সেসময় সাহাবায়ে কেরাম প্রাথমিকভাবে তা অনুসরণ না করে ওমরাহ করার সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিলেন। উম্মে সালামা (রা.) যখন বিষয়টি জানতে পারলেন, তখন তিনি মহানবি (সা.)-কে নিজের চুল নিজেই কাটতে পরামর্শ দিলেন। সুতরাং সাহাবায়ে কেরাম হযরত রাসুল (সা.)-কে চুল কাটতে দেখে তাঁরাও একে অপরের চুল কাটতে লাগলেন। এভাবেই উম্মে সালামা (রা.)-এর পরামর্শে সাহাবায়ে কেরাম সংঘাত অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসেন। আর তাঁর আইনশাস্ত্রে দূরদর্শিতার এমন উদাহরণ আরো অনেক রয়েছে। (আল-আলাম: খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৯৭)
উম্মুল মু’মিনিন জুওয়াইরিয়া (রা.): উম্মুল মু’মিনিন জুওয়াইরিয়া (রা.) ছিলেন বনু মুস্তালিক গোত্রের সরদার হারিসের কন্যা। ‘নিসাউ হাউলির রাসুল’ নামক গ্রন্থের লেখক মুহাম্মদ বুরহান (রহ.) তাঁকে ফকিহ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা ‘মুসান্নাফে আবি শাইবা’ ও ‘মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক’ গ্রন্থদ্বয়ে তাঁর বহু ফাতওয়া সংকলিত হয়েছে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১০৬; মুসান্নাফে আবি শাইবা : খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৮)
জায়নাব বিনতে আবি সালামা (রা.): জায়নাব বিনতে আবি সালামা (রা.) ছিলেন মহানবি (সা.)-এর স্ত্রী উম্মে সালামাহ (রা.)-এর কন্যা (আগের সংসারের সন্তান ছিলেন)। তিনি হযরত রাসুল (সা.)-এর সাহচর্যে বড় হয়েছেন। আল্লামা ইবনে আসির আল-জাজরি ও ইবনে আবদুল বার (রহ.) তাঁকে তাঁর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারী আইনবিদ-ফকিহ বলে ঘোষণা করেছেন। আর আবু রাফি (রহ.) বলেন, আমি যখনই মদিনার কোনো নারী ফকিহের কথা আলোচনা করতাম, তখন শুধু জায়নাব বিনতে আবি সালামা (রা.)-এর আলোচনা করতাম। (আল-ইসতিয়াব: খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৮৫৫, আসাদুল গাবাহ: খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ১৩২, তাহজিবুত তাহজিব: খণ্ড ১২, পৃষ্ঠা ৪৫০)
ফাতিমা বিনতে কায়স (রা.): তিনি একজন বিখ্যাত নারী সাহাবি। তিনি প্রথম দিকে হিজরতকারী নারীদের মধ্যে একজন। ইমাম শাবি (রহ.) তাঁকে ফিকহবিদ বলেছেন। কেননা একবার তিনি তালাকপ্রাপ্তা নারীর ভরণপোষণ ও বাসস্থানের বাধ্যবাধকতা না হওয়া সম্পর্কিত ফাতিমা বিনতে কায়েস (রা.)-এর হাদিস বর্ণনা করেন, তখন উপস্থিত এক ব্যক্তি বললেন যে হযরত ওমর (রা.) ফাতিমা বিনতে কায়েস (রা.)-এর এই বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। উক্ত ব্যক্তির প্রতি উত্তরে ইমাম শাবি (রহ.) বলেন, আমি কী একজন নারী আইনবিদকে সমর্থন করব না, যিনি নিজেই এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন? (মুসতাখরিজে আবি আওওয়ানা: খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৮১)
সাফিয়া বিনতে শাইবা (রা.): সাফিয়া (রা.) সর্বকনিষ্ঠ নারী সাহাবিদের একজন। আল্লামা জাহাবি (রহ.) তাঁকে ফকিহ বলেছেন। জ্ঞানের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। ইমাম বুখারি তার বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। অনেকেই তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন, বিশেষ করে সুনানের মুহাদ্দিসরা। ইমাম বুখারি (রহ.)-ও তাঁর রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪৭৪, তাহজিবুত তাহজিব: খণ্ড ১২, পৃষ্ঠা ৩৮১, আল কাশেফ: খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫১২)
উম্মে দারদা সুগরা (রা.): তাঁর নাম হাজিমা বিনতে হাই। তিনি ছিলেন মহানবি (সা.)-এর সুপরিচিত সাহাবি হযরত আবু দারদা (রা.)-এর দ্বিতীয় স্ত্রী। ইমাম বুখারি, ইমাম মাকহুল (রহ.)-সহ অন্য বহু আলেম তাঁকে ফকিহ বলেছেন। তিনি তাঁর গোটা জীবন হাদিস ও আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন এবং তারপর তা প্রচার-প্রসারে ব্যয় করেছেন, বিশেষ করে আইনশাস্ত্রে তাঁর উচ্চ অবস্থান ছিল। আল্লামা নববী (রহ.) বলেন, তাঁর ফিকহবিদ হওয়ার ব্যাপারে আহলে ইলমরা একমত। (সহিহ বুখারি: খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৬৫, তাহজিবুল কামাল: খণ্ড ৩৫, পৃষ্ঠা ৩৫৫, তাহজিবুল আসমা ওয়াল লুগাত: খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬২৩)
উমরাহ বিনতে আবদুর রহমান (রা.): উমরাহ বিনতে আবদুর রহমান হলেন একজন নারী তাবেঈ। তাঁর পিতার নাম আবদুর রহমান এবং দাদার নাম সাদ বিন জারারা (রা.); উভয়েই সাহাবি। তিনি বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবু বকর ইবনে হাজম (রহ.)-এর খালা। তিনি শৈশব থেকেই হযরত আয়েশা (রা.)-এর তত্ত্বাবধানে এবং লালন-পালনে বড় হয়েছেন। (তাহজিবুল কামাল: খণ্ড ১২, পৃষ্ঠা ৪৩৯, আল-আলাম : খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৭২)
জাহাবি ও হিজরানি (রহ.)-সহ প্রমুখ বহু আলেম তাঁকে ফকিহ বলেছেন। ইমাম জুহরি (রহ.) বলেন, আমি যখন উমরাহ (রা.)-এর কাছে আসলাম, তখন তাঁকে জ্ঞানের অন্তহীন মহাসমুদ্র দেখতে পাই। (তারিখুল ইসলাম: খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১১৫১, কিলাদাতুন নাহর: খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৫০৬, সিয়ারু আলামিন নুবালা: খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৫০৮)
বিনতে জায়েদ বিন সাবিত আনসারি (রা.): বিনতে জায়েদ বিন সাবিত আনসারি (রা.) বিখ্যাত ও সুপ্রসিদ্ধ সাহাবি ‘কাতিবে ওহি’ জায়েদ বিন সাবিত (রা.)-এর কন্যা। তাঁকে বহু বিদগ্ধ আলেম ফকিহ বলেছেন। ইবনে হাজার (রহ.) তাঁকে ফকিহ বলেছেন। ইমাম বুখারি (রহ.) হায়েজ (পিরিয়ড) সম্পর্কিত তাঁর রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন এবং ইমাম মালিক (রহ.)-ও বর্ণনা করেছেন। (তাহজিবুত তাহজিব: খণ্ড ১২, পৃষ্ঠা ৫১২)
মুয়াজা আদাবিয়া (রা.): মুয়াজা বিনতে আবদুল্লাহ আদাবিয়া (রা.) হলেন অত্যন্ত ধার্মিক, পরহেজগার ও প্রখর জ্ঞানের অধিকারী। আইয়ুব সাখতায়ানি, জাফর বিন কায়সান, ইয়াজিদ আল-রিশকসহ বিদগ্ধ মুহাদ্দিসরা তাঁর কাছ থেকে ইলম অর্জন করেছেন। জাহাবি ও হিজরানি (রহ.) তাঁকে ফকিহ বলেছেন। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস জাফর বিন কায়সান (রহ.) বলেন, আমি মুয়াজা আদাবিয়া (রা.)-কে দেখেছি যে তিনি পর্দায় ছিলেন এবং নারীরা তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছিল। (আল ইবার ফি খাবার: খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৯২, কিলাদাতুন নাহর: খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১২, আল ইলাল ওয়া মারিফাতুর রিজাল: খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৮০)