অধ্যক্ষ মো. নিয়ামুল কবির
সত্যিকারের আলোকিত মানুষ মানেই নিবেদিত মানুষ, একজন নিঃস্বার্থ মানুষ। সর্বোপরি, ঐশ্বরিক গুণে গুণান্বিত এমন একজন মানুষ, যিনি সমাজকে আলোকিত করেন। আগামী প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করার পথ দেখান, মূল্যবোধ ও চেতনার বীজ বপন করেন। আদব, বিশ্বাস, সাহস ও মহব্বত জোগান। সময়ের প্রয়োজনে যুগে যুগে আলোকিত মানুষগণ ব্যক্তি, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে আলোকিত করে গেছেন। রেসালতের যুগে নবি-রাসুল প্রেরিত হয়েছেন। বেলায়েতের যুগে (বন্ধুত্বের যুগ) নায়েবে রাসুল বা রাসুলের প্রতিনিধিরা আবির্ভূত হন। এছাড়া শুধুমাত্র পার্থিব কল্যাণে নিয়োজিত সুশীল সমাজও আলোকিত মানুষ হিসেবে সাব্যস্ত হন, তবে তাদেরকে অবশ্যই পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী হতে হবে। আলোকিত মানুষদের পর্যায়ক্রম নিম্নরূপ-
১. অলী-আল্লাহ্, ২. বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ, ৩. শিক্ষক ও আলেম, ৪. শিল্পী ও কবি-সাহিত্যিক, ৫. চিকিৎসক ও প্রকৌশলী, ৬. রাজনীতিবিদ ও আইনবিদ এবং ৭. দাতা ও সমাজসেবক।
এক্ষেত্রে শুধুমাত্র অলী-আল্লাহগণ ইলহাম প্রাপ্ত বা খোদায়ী জ্ঞান প্রাপ্ত হন। সুশীল সমাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এলমে কিতাব দ্বারা জ্ঞান প্রাপ্ত হন। ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্ব থেকে অবস্থানচ্যুত অথবা সমাজচ্যুত যেন না হন, তজ্জন্যে কিছু কলাকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। যেমন-শিক্ষকগণ হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষককে অনেক কিছু বিবেচনায় আনতে হয়। এ কারণেই আমেরিকার শিক্ষাবিজ্ঞানী ড. বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুম শিক্ষার উদ্দেশ্যকে মূলত ৩টি ডোমেইন বা ক্ষেত্রে ভাগ করেছেন। ক্ষেত্রগুলো হলো-
ক. জ্ঞানমূলকক্ষেত্র (Cognitive Domain): জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রতিভা, এইক্ষেত্রে জ্ঞানমূলক বা মননশীলতার ক্ষেত্র হয়।
খ. আবেগিক বা উপলব্ধিমূলকক্ষেত্র (Affective Domain): এইক্ষেত্রে বোধগম্যতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়।
গ. ক্রিয়ামূলক বা মনোপেশীজক্ষেত্র (Psychomotor Domain): কাজের যোগ্যতা বা দক্ষতা তৈরির ক্ষেত্র।
এ যোগ্যতা অর্জনে প্রশিক্ষণ একটি জরুরি বিষয়। সময়োচিত প্রশিক্ষণে দেহ ও মন উভয় প্রফুল্ল থাকে। সুন্দর ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে। এ প্রসঙ্গে জার্মান দার্শনিক জর্জ উইলহেলম ফ্রেডরিখ হেগেল (১৭৭০-১৮৩১ খ্রি.) বলেন- “দুটো নীতি অবলম্বন করলে মানুষ প্রকৃত ব্যক্তিত্ব অর্জন করে আত্মোপলব্ধি লাভ করতে পারে। এই দুটো নীতি হলো- (ক) মানুষ হও (Be a Person) এবং বাঁচার জন্য মরো (Die to Live)।”
হেগেল ছিলেন পূর্ণতাবাদ (Perfectionism)-এর প্রবক্তা। এফ. এইচ. ব্র্যাডলি এবং টি.এইচ. গ্রিন এ দুজন ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন দার্শনিক হেগেলের অনুসারী। এই মতবাদের মূল বক্তব্য হলো বিশেষ কল্যাণ বা আত্মসুখবাদ এবং সার্বিক কল্যাণ বা সর্বসুখবাদের মধ্যে কোনো বৈরিতা নেই। উভয়ের মাঝে যোগসূত্র আছে। প্রতিটি ব্যক্তি-আত্মার সম্মিলিত প্রয়াসই সামাজিক-আত্মার পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ। দার্শনিক হেগেলের পূর্ণতাবাদের ব্যাখ্যা প্রদান করে এমন দুটি উক্তি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। হেগেলের মানুষ হও বা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হও (Be a Person) উক্তিটির ব্যক্তিত্ব বলতে কোনো ব্যক্তি বিচ্ছিন্নতা বোধকে বুঝায় না। ব্যক্তির নীতিগত দিকটা (Moral Perspective) স্পষ্ট করে। এরও কারণ আছে। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।
হেগেলের ২য় উক্তিটি বাঁচার জন্য মরো (Die to Live)-এর সারমর্ম হলো মানুষকে নিম্নতর জীবন থেকে মুক্তি পেতে হবে। পুরোপুরি যৌক্তিক সত্তাময় জীবনবৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে।
আলোকিত মানুষ হওয়া প্রসঙ্গে মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ্ভিত্তিক কিছু মৌলিক পদ্ধতি উপস্থাপন করেন, যা অনুসরণযোগ্য।
১. আত্মশুদ্ধি: সকলেরই আত্মার বিশুদ্ধতা অর্জন করা প্রয়োজন।
২. দিলজিন্দা বা হৃদয়ে প্রভুর স্মরণ: আমাদের ক্বালব বা হৃদয় আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালার জিকির (স্মরণ) থেকে গাফেল (বিমুখ) রয়েছে, হৃদয়ে প্রভুর স্মরণ জারি করা ফরজ।
৩. হুজুরি ক্বালব বা একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায়: আমরা বেশিরভাগ সময় পার্থিব কাজে ব্যস্ত থাকি। এই পেরেশানি মন নিয়ে কোনো ইবাদতই সুষ্ঠুভাবে পালন করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে নামাজ। একমাত্র হুজুরি ক্বালব বা একাগ্রচিত্তে নামাজ কায়েম করা সম্ভব।
৪. রাসুল প্রেমিক হওয়া: হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি নিজের পিতামাতা, সন্তানসন্ততি ও অন্য সকল মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি ভালো না বাসবে, সে মু’মিন হতে পারবে না।” (বোখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭)
মোহাম্মদী ইসলাম রাসুল প্রেমিক হওয়ার দীক্ষা দেয়। এই দীক্ষা আলোকিত মানুষ হওয়ার শর্ত। এ প্রসঙ্গে সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন, “জাগতিক বিদ্যা (এলমে কিতাব) শিক্ষা করে নফ্স কখনো পরিশুদ্ধ করা যায় না। কারণ নফ্স সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জগতের বস্তু বিধায় তাকে নিয়ন্ত্রণ বা পরিশোধনের জন্য মোর্শেদে কামেলের তাওয়াজ্জোহ্ শক্তির প্রয়োজন হয়।”
নফ্স বা জীবাত্মার কুপ্রবৃত্তির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে সুপ্রবৃত্তির বৃত্ত রেখায় প্রবেশ করতে হয়। যাকে বলে পরিশুদ্ধ আত্মা। এ পরিশোধিত আত্মাই পরমাত্মা বা রুহ। এ ঘরানার কর্মসূচি যারা পরিচালনা করেন তারা হলেন দীক্ষাগুরু। দীক্ষাগুরুর গাইড লাইন ব্যতীত সমাজের মানুষদের জাগতিক কিংবা পারমার্থিক মুক্তি অসম্ভব! এজন্য সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) বেশি বেশি মোরাকাবা করার শিক্ষা দিতেন। এ গুণাবলি অর্জনের জন্য দার্শনিকগণ এক ধরনের ধ্যান-সাধনা বা মেডিটেশন (Meditation)-এর উপর জোর দেন। এছাড়া ভারতীয় ঋষিগণ যোগ-সাধনা বা যোগ-ব্যায়াম (Yoga) অনুশীলনের কথা বলেন।
উল্লিখিত পদ্ধতিগুলো রপ্ত করতে পারলেই আশেকে রাসুল বা উম্মতে মোহাম্মদীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া সম্ভব। আর তখনই তিনি হবেন আলোকিত মানুষ। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন দেওয়ানবাগ শরীফের পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর। তিনি সমাজের মধ্যমণি, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক। পরিশুদ্ধ আত্মা বা শুদ্ধ মানুষ তৈরির স্বার্থে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ এর সুফল লাভ করবেন বলে আমাদের দৃঢ বিশ্বাস।
তথ্যসূত্র
১. শিক্ষাবিজ্ঞান বিষয়ক রিসোর্স বুক, সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক প্রণীত, মাউশি শিক্ষা ভবন, ১৬, আব্দুল গণি রোড, ঢাকা-১০০০, ডিসেম্বর ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ১৮৩
২. ডক্টর মুহাম্মাদ আবদুল হাই ঢালী, নীতিবিদ্যা আদর্শনিষ্ঠ ও পরা-নীতিবিদ্যা, পুঁথিঘর লি., ৭৪ ফরাশগঞ্জ, ঢাকা, ২য় সংস্করণ, মাঘ ০১, ১৩৯২, পৃষ্ঠা – ৪৭
৩. আত্মার বাণী, ৩২শ বর্ষ: ২য় সংখ্যা, সূফী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৫৪ আরামবাগ, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০, আগস্ট ২০১২ খ্রি., পৃষ্ঠা ০২।
৪. মোহাম্মদী ইসলামের ওয়াজিফা, পৃষ্ঠা ০১
৫. জগদ্গুরু মুহাম্মদ (দ:), মমপ্রকাশ, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, পৃ. ৯১
৬. এজিদের চক্রান্তে মোহাম্মদী ইসলাম, পৃ. ২৪১-২৪২
[লেখক: অধ্যক্ষ, নবযুগ কলেজ, কুশুরা, ধামরাই, ঢাকা]