আতাউর রহমান খসরু: ইসলাম আগমনের বহু পূর্বে আরব ভ‚খণ্ডের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। আরব বণিকরা ভারত মহাসাগরের উপক‚লীয় অঞ্চল থেকে ব্যাবসায়িক পণ্য সংগ্রহ করত। ইসলাম আগমনের পর এই যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি পায়। সুপ্রাচীন এই যোগাযোগের ফলে আরবরা যেমন ভারতীয়দের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, তেমনি ভারতীয়রাও আরবদের কাছ থেকে বহু বিষয় গ্রহণ করেছিল।
পারস্পরিক সম্পর্ক
আরব ও ভারতীয় নাগরিকরা পরস্পরকে সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখত। আরবরা ভারতীদের সম্মানের চোখে দেখত তারা দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পে এগিয়ে থাকার কারণে। আরবদের চোখে ভারতীয়রা ছিল মেধাবী ও বুদ্ধিমান জাতি। যারা মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
যদিও আরব ভারতীয় সামাজিক বিভক্তি, জাতিগত অনৈক্য, বর্ণপ্রথা ও ধর্মীয় অধঃপতনকে অপছন্দ করত। অন্যদিকে আরবদের চিন্তার উদারতা, ধর্মীয় সহনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা ভারতীয়দের অন্তরে তাদের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে উত্তর-পশ্চিম ভারতে আরব বাহিনীর হামলাগুলো বাদ দিলে ভারতের সঙ্গে আরবদের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সুসংহত। যেসব আরব ভারতে বসবাস শুরু করেছিল তারা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করত।
এমন কোনো ভারতীয় শাসক তাদের প্রাশাসনিক দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। যেসব আরব বণিক দক্ষিণ ভারত ও উপক‚লীয় অঞ্চলে যাতায়াত করত তাদেরও সম্মানের চোখে দেখা হতো। তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ এবং ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ভোগ করত।
ভারতীয় সমাজে আরবদের প্রভাব
সুপ্রাচীন বাণিজ্যিক যোগাযোগ, ইসলাম প্রচারকদের প্রচেষ্টা ও রাজনৈতিক সাফল্যের কারণে ভারতে ইসলামের প্রভাব অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। বিশেষত ভারতীয় সমাজে ইসলামের ধর্মীয় প্রভাব ছিল দৃশ্যমান।
মুসলমানরা ভারতীয়দের জন্য বহু মূল্যবান উপহার সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার ছিল নিষ্কলুষ একত্ববাদের বিশ্বাস। যে বিশ্বাস বান্দা ও তার প্রতিপালকের ভেতর সব ধরনের মাধ্যম অস্বীকার করে। বান্দার ইবাদত ও প্রার্থনা কোনো মাধ্যম ছাড়াই মহান আল্লাহর কাছে পৌঁছায়। এ বিশ্বাস ভারতবাসীকে হাজার বছরের দাসত্বের শেকল থেকে মুক্তি দেয়। কেননা মানুষরই একটি শ্রেণি তাদের ও মহান প্রতিপালকের মাঝে এমন অভেদ্য দেয়াল তুলে দিয়েছিল যে তারা বিশ্বাস করত প্রভুর কাছ থেকে তাদের চাওয়া ও পাওয়ার কিছুই নেই।
ভারতবাসীর প্রতি মুসলমানের অনুগ্রহ হলো, তারাই ভারতীয় সমাজে মানবিক সাম্যের দাবি প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কেননা ইসলামে বর্ণবৈষম্য ও বর্ণপ্রথার কোনো স্থান নেই। কোনো মানুষই জন্মসূত্রে অস্পৃশ্য নয়, কেউ জন্ম থেকে নাপাক নয়। কোনো মূর্খ ব্যক্তির জন্য শিক্ষা গ্রহণ করা নিষিদ্ধ নয়। পেশার ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বৈষম্য ইসলাম সমর্থন করে না। সব মানুষ ভাই ভাই। তারা একসঙ্গে বসবাস করা, পানাহার গ্রহণ করা, শিক্ষা গ্রহণ করাসহ সব সামাজিক কাজ করার অধিকার রাখে। ইসলাম ভারতীয় সমাজের কঠোর সামাজিক বৈষম্য ও বর্ণপ্রথাকে শিথিল করতে জোরাল ভ‚মিকা রেখেছিল। অস্পৃশ্যতার দেয়াল ভেঙে সমাজ সংস্কারের সূচনা করেছিল। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু ঐতিহাসিক এই সত্যের স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে যেসব যোদ্ধাদের ভারতে প্রবেশ এবং ভারতে মুসলিম আগমন ভারতবর্ষের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় সমাজে যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিল তারা তা দূর করেছে। তারা প্রকাশ করে দিয়েছে বর্ণপ্রথা, অস্পৃশ্যতার রীতি এবং পৃথিবীতে বিচ্ছিন্নতার নানাদিক-ভারতবাসী যার ভেতর বসবাস করত। নিশ্চয়ই ইসলামের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের নীতি মুসলিমরা যা বিশ্বাস করত এবং জীবনে ধারণ করত ভারতীয় চিন্তাধারায় তা গভীর প্রভাব ফেলে। এর দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল শূদ্ররা (হিন্দু সমাজ কাঠামোর চতুর্থ শ্রেণি)। ভারতীয় সমাজ যাদের সাম্য ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল।’ (দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা ৩৩৫ ও ৫২৬)
মুসলিম ভারতে বহু নতুন বিদ্যা ও জ্ঞান বয়ে এনেছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ইতিহাস। ভারতবর্ষ ইতিহাসচর্চায় অনেক পিছিয়ে ছিল। ভারতীয় পাঠাগারগুলোতে সঠিকার্থে কোনো ইতিহাস গ্রন্থ ছিল না। ভারতে যা ছিল তা হলো ধর্মীয় পুস্তক-পুস্তিকা ও উপাখ্যান যেখানে বিভিন্ন যুদ্ধ ও চুক্তির বিবরণ রয়েছে। যেমন মহাভারত, রামায়ণ। মুসলিমরা এখানে ইতিহাস শাস্ত্রের ওপর এমন সুবিশাল গ্রন্থাগার গড়ে তোলে, পৃথিবীতে যার দৃষ্টান্ত মেলা ভার। গুস্তাভ লে বন তার ‘হাদারাতুল হিন্দ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘প্রাচীন ভারতের কোনো ইতিহাস নেই। তাদের গ্রন্থগুলোতে অতীতের গ্রহণযোগ্য কোনো সূত্রও পাওয়া যায় না। একাদশ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম অভিযানের আগে ভারতে ইতিহাসচর্চা শুরু হয়নি। মুসলিম আগমনের পর মুসলিমদের অবদানে তার সূচনা হয়।’
ভারতবর্ষ মুসলিমদের কাছ থেকে চিন্তার উদারতা ও চিন্তার শক্তি লাভ করেছে। অর্জন করেছে সাহিত্য ও কবিতার নতুন অর্থ। যদি তারা তা অর্জন করতে না পারত তবে ভারতীয়দের মন ও মননে গবেষণা, বুদ্ধিবৃত্তি ও সাহিত্যের উন্নয়নের এই ধারা সৃষ্টি হতো না। ভারতবর্ষের জীবনযাত্রা, শিল্প ও নগরায়নে মুসলিম প্রভাব ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রজ্জ্বল। তারা ভারতীয় সমাজে এমন এক নতুন জীবনধারা সূচনা করেছিল, যা প্রাচীন ধারাগুলো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন ইউরোপের মধ্যযুগীয় জীবনধারার তুলনায় ভিন্ন বর্তমান জীবনধারা।
আরবসমাজে ভারতের প্রভাব
আরব মুসলিমরা যেমন ভারতীয় সমাজ সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি তারা ভারতীয় জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি দ্বারা উপকৃত হয়েছে। ড. সাইয়েদ মাকবুল আহমদ বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আরবদের সঙ্গে ভারতীয়দের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পরিমাণ বেশি। আরবরা ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে। বিশেষত আরবি ভারতীয় সাহিত্য থেকে রশদ গ্রহণ করেছে। বিপুল পরিমাণ ভারতীয় সাহিত্য আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আরবি কাব্যসাহিত্য ও সংগীত ভারতীয় ভাববাদ ও আধ্যাত্মবাদ দ্বারা প্রভাবিত। বহু ভারতীয় খাদ্য আরবদের দস্তরখানে স্থান করে নিয়েছে। ভারতীয় দর্শন বিদ্যা ও গণিত শাস্ত্রের জ্ঞান, ভারতীয় স্থাপত্যরীতি, সূ² শৈল্পিক কারুকাজ আরবদের প্রভাবিত করেছে।
আল-মুসলিমুনা ফিল হিন্দ ও আলাকাতুল আরাবিয়্যাতুল হিন্দিয়্যা অবলম্বনে