আমার নজরুল, আমার গানের বুলবুলি

আমার নজরুল, আমার গানের বুলবুলি

নিরুপমা রহমান
জগৎজোড়া লোকের কাছে ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো’ বিদ্রোহী কবি তিনি, আবার সেই প্রবল দ্রোহের কবিই বাঙালির ‘দুখু মিয়া’। ‘চির-বিদ্রোহী বীর’ এই কবি নিজেই বলেছেন ‘চির-উন্নত শির’ তাঁর। এমন প্রবলতর জানান যখন দিয়ে যাচ্ছেন কবিতার ছত্রে ছত্রে, সেই কবিই আবার সেই একই কবিতায় বলছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য’। আর এই নিরন্তর গভীর বৈপরীত্যময়তাই নজরুলকে বাঙালির প্রাণের কবি করে তুলেছে। যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তাই আপামর জনসাধারণ থেকে শুরুকরে অভিজ্ঞ জ্ঞানী গবেষক পর্যন্ত সকলের কাছে নজরুল তাই একই সঙ্গে দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি। আমার কাছে নজরুল বড্ড বিশেষ, অতি আপনার। ‘সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে’ যিনি আমার সমগ্র সত্তা ছুঁয়ে আছেন, জুড়ে আছেন; যাঁর গানে গানে আমি নিরন্তর খুঁজে বেড়াই ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন’-কে। সেই কোন সে শৈশবে গানকে নিয়ে আমার যে পথ চলার শুরু কিংবা গানকে ঘিরে আমার যে একান্ত আপনার জগতের পত্তন, অবচেতনেই সেখানে নজরুল চিরমূর্তমান।

আশৈশব গান, গানের সুর, সুরের বোধ আমার অন্তঃপুরে এক সুবিশাল জায়গা জুড়ে আছে। পরিণত বয়সে এসে আজ আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করি কীভাবে এই অনুষঙ্গ আমার মনোজাগতিক ভুবনকেই শুধু সংগঠিত করেনি, সংগঠন করেছে আমার সমগ্র আত্মপরিচয়, আমার বাঙালিয়ানার বোধ। আর অবচেতনেই নজরুলের গান আমার জীবনপথের বাঁকে বাঁকে, এর প্রতিটি সন্ধিক্ষণে আমায় সঙ্গ দিয়েছে, দিয়েছে বৌদ্ধিক ভাবনার জন্ম, দিয়েছে সৃজনশীলতার প্রেরণা। যেকোনো কঠিন মুহূর্তে আমি নিরন্তর অনুপ্রেরণা পাই ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ শীর্ষক অভিভাষণে গানকে নিয়ে নজরুলের নিজের বলা কথাতেই- ‘জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান-বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।’

জীবন এক চলমান প্রক্রিয়া। প্রত্যেকটি মানুষের জাগতিক বোধ-অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে তার জীবনাচরণের মনস্তাত্ত্বিক দর্শন থেকে তার সৃষ্টিশীলতা কিংবা সৃজনশীলতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারে এই চলমান প্রক্রিয়া ভিন্ন থেকে ভিন্নতর স্বতন্ত্র মাত্রা পায়। তাই আজ অবচেতনে নয়, বরং সচেতনেই জানি আমার এই অকিঞ্চিৎকর জীবনের পথ পরিক্রমায় আমার চিরসখা গান আর গানের বোধকে যদি ‘পার্থ’ হিসেবে ভাবি, তবে নজরুলের গান ‘পার্থসারথী’ হয়ে আমাকে নিরন্তর চিনিয়ে যাচ্ছে চিরসখা ‘পার্থ’কে, আর ‘পার্থ’র চোখ দিয়ে জগৎসংসারকে। সুতরাং জীবনের কঠিনতম সময়ে বারংবার আমার ‘পার্থসারথী’ সম নজরুলের কাছেই ফিরে যাই, তাঁর গানের কথাতেই পরম পুরুষের কাছে সানুনয় নিবেদন করি ‘পাঞ্চজন্য শঙ্খ’ বাজিয়ে- ‘চিত্তের অবসাদ দূর কর কর দূর,/ ভয়-ভীতজনে কর হে নিঃশঙ্ক।’
গবেষক নারায়ণ চৌধুরী তাঁর ‘কাজী নজরুলের গান’ শীর্ষক গ্রন্থে যথার্থই লিখেছেন, ‘নজারুল সত্তায় যেন এক অফুরন্ত সৃষ্টির সঞ্চয় লুকানো ছিল, রূপকথার কল্পবৃক্ষে নাড়া দিলেই যেমন তার থেকে সোনা রূপা ঝরে পড়ত, তেমনি তাঁর গানের গাছে নাড়া দিলেই চাইতে না চাইতে রকমারী গানের ফল টুপ করে খসে পড়ত। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নজারুল এক অতি অদ্ভুত সৃষ্টিশীল প্রতিভা। নব-নবোন্মেষ শালিনী সুর সৃজনের প্রতিভায় তিনিই তাঁর তুলনা, তাঁর আর কোনো দোসর নেই।’ আমার নজরুল সত্যিকার অর্থেই সেই রূপকথার কল্পবৃক্ষ। অথবা আমার নিজের মতো করে বললে নজরুলের গানের মাঝে আমি অনিঃশেষ এক গুপ্তধন ভান্ডারে মণি-মাণিক্য সন্ধান করে বেড়ানোর আনন্দ খুঁজে পাই। যত পাই তত আরো খুঁজি, আরো কিছু পাবার আশায়। সেই খোঁজার আনন্দে নেই ক্লান্তি, নেই নিরাশা, নেই হারানোর ভয়। এ এক পরম আনন্দ। আর সেই খোঁজে নতুন কিছু পাওয়ার আনন্দ যেমন আছে, তেমনি অবাক বিস্ময়ে দেখি আগে পাওয়া মণি-মাণিক্যও জীবনের এক এক বয়সে, এক এক স্তরে ভিন্ন ভিন্ন আলো ছড়ায়- বোধের ভিন্নতায়, ভাবনার পার্থক্যে নজরুলকে নতুন করে চেনায়। তাই বয়সে, বোধে, মননে, সৃজনে আমার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার নজারুলও আমার কাছে প্রকাশমান হন, বিকশিত হন, উন্মীলিত হন।

খুব ছোটবেলাতে স্কুলে যাওয়ারও আগে গান শেখা শুরু আমার। আর সে একেবারে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয়সংগীত। সে-বয়সে রাগসংগীতের রস, ভাব বা প্রকৃতি বোঝার মতো বোধ বা বুদ্ধি কোনোটাই ছিল না আর তা থাকার কথাও হয়তো নয়। অনেক পরেযখন জেনেছি চূড়ান্ত বৈপরীত্যময় প্রেম আর ক্রোধ যেই শব্দে একাকার হয়ে গেছে, হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতে সেই রাগ শব্দটি এসেছে রঞ্জক থেকে; তখন বুঝেছি স্বরের বিন্যাসে গাঁথা সুরের লহরী মনকে রঞ্জিত করে বলেই না ‘রঞ্জয় দি ইতিরাগ’। প্রেমআর ক্রোধ দুই-ই মনকে উদ্দীপিত করে, মনকে রাঙায়। ঠিক তেমনি সুরের খেলায় আর স্বরের মেলায় এই রঞ্জনা করার যে প্রয়াস সেটাই রাগের আসল কথা। এখানে ব্যাকরণ নয়, বরং স্বরের বৌদ্ধিক আর সৃজনশীল মেলবন্ধনে সৃষ্ট সুরেলা অনুরণনের যে ভাবপূর্ণ ব্যাপ্তি সেটাই মনকে রাঙায়, চিত্তে দোলা দেয়। আর সত্যি বলতে আমার জীবনে রাগসংগীতে স্বরসংগতির জ্ঞানের সঙ্গে এর রস আর ভাবের বোধের যে মিলন ঘটেছে তার উৎসমুখেও দাঁড়িয়ে আছেন নজরুল। রসকষহীন ব্যাকরণে রাগের সত্যিকার পরিচয় মেলে না, একে ছাপিয়ে প্রতিটি রাগের যে একটি চরিত্র আছে,রস-রূপ-ভাব আছে, নজরুলের গানই যেনতা আমাকে প্রথমে জানান দিয়েছিল। তাঁর গানে অভূতপূর্ব বাণীর সঙ্গে সুরের যে মিশেল আর তার যে চিত্রিত রূপকল্প- আমার মনে খুব সহজেই সে বিভিন্ন রাগের রূপখানি এঁকে দিয়েছিল। সত্যিকার অর্থে তাঁর গানেই আমার বোধ জাগলো প্রথম-‘রঞ্জকোজন চিত্তানাং স রাগঃ কথিতো বধৈঃ’ -রাগের সরগম দিয়ে ছবি আঁকা যায়, আর তাতে চিত্ত হরণ করাও সম্ভব। সেই স্কুলপড়ুয়া আমার মনে আহির ভৈরব রাগে বাঁধা ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ গানটি শেখার সময় একদিকে যেমন ‘আহির’ শব্দের ভেতর দিয়ে গোপবালকের রূপকল্পের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল, ঠিক তেমনিভাবে বাংলা গানে সুরের সঙ্গে বাণীর প্রগাঢ় সম্পৃক্ততার বিষয়টি মনে গেঁথে গিয়েছিল গভীরভাবে। সেই গানের বাণী পড়তে পড়তে কোন ফাঁকে যেন আমার শিশুমনে আঁকা হয়ে গিয়েছিল ভোরবেলাকার এক অপূর্ব দৃশ্য যেখানে কোনো এক সবুজ-শ্যামল গ্রামে ঊষালগ্নে এক রাখাল বালক তার পোষ্যদের নিয়ে যাচ্ছে মাঠের দিকে। প্রত্যুষকালের রাগ আহির ভৈরবের প্রকৃতি শান্ত, এর সুরের আমেজে আছে ভক্তিরস। ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ গানের বাণীর মাঝে প্রকাশমান রূপকল্প আর আহির ভৈরব রাগে বাঁধা এর সুর যে কারো মনেই এক শান্ত ধ্যানী যোগীর এক চিত্রকল্প এঁকে দেয়, যেখানে কি না জ্যোতির্ময় সেই যোগী নীরবে এসে দুয়ারে দাঁড়িয়েছেন- এ যেন আহির ভৈরব নিজেই ‘বাঘছাল পরিহর, ধর নটবর বেশ, পর নীপমালা’য় সেজে ঋষিমূর্তি ধরে এসেছেন। এ-গানের মধ্য দিয়েই আহির ভৈরব রাগের চিত্রকল্প চিরতরে আমার মনে আঁকা হয়ে গিয়েছিল। সেই ছোটবেলায় মনে গেঁথে যাওয়া ভাবনা থেকেই ঋষিরূপী আহির ভৈরবকে বড় আপনার লাগে। যতবার আহির ভৈরব রাগটি গাইতে বসি, ততবার এই ঋষিকে মনে মনে কল্পনা করে নিজেই এক ‘আহিরিণী’ হয়ে সানুনআকুতি জানাই ‘ত্রিভুবন-পতি’কে যেন তিনি প্রিয় হয়ে দেখা দেন ‘নবমেঘে চন্দনে ঢাকি অঙ্গজ্যোতি’।

অথবা সেই সে কোন ছোটবেলায় যখন বৃন্দাবনী সারং রাগে বাঁধা ‘তৃষিত আকাশ কাঁপে রে’ শুনেছিলাম তখন তৎক্ষণাৎ ‘প্রখর রবির তাপে’ তাপিত গ্রীষ্মদিনের কী দারুণ এক রূপকল্প সেই শিশুমনেই আঁকা হয়ে গিয়েছিল। তারপর জানলাম, ফারসি ভাষায় ‘সারং’ শব্দের অর্থ মেঘ হলেও সারং ঘরের রাগগুলোর ঋতুগ্রীষ্ম। কিন্তু গ্রীষ্মশেষের সেই গ্রীষ্মকালে খানিক মেঘের আভাস আছে, ধীরে ধীরে তার সঞ্চার আছে অল্পবিস্তর। ক্রমশ যখন জানা হলো, বৃন্দাবনের প্রখর দাবদাহে মেঘের তৃষার মতোই বৃন্দাবন শব্দের মাঝে লুকিয়ে আছে শ্রীকৃষ্ণের অনুষঙ্গ পাওয়ার আকাঙক্ষা, তখন বৃন্দাবনী সারং রাগ হয়ে উঠল আমার কাছে গনগনে তপ্ত দিনে মেঘের দেখা পাওয়ার পরম আকুতি প্রকাশের সুর। আর তাতে বাঁধা গান ‘তৃষিত আকাশ কাঁপেরে’ তৈরি করে দিলো গ্রীষ্মদিনের রূপকল্প, যা আমার একান্ত নিজস্ব।


চলবে

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *