বিখ্যাত কবি দিনেশ দাশ রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা ভরে লিখেছিলেন-
“আকাশে বরুণে দূর স্ফটিক ফেনায়
ছড়ানো তোমার প্রিয়নাম,
তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা
কোনখানে রাখবো প্রণাম!” (প্রণমি/দিনেশ দাশ)
শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অন্যতম মাইলস্টোন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু কাব্য সাহিত্যেই নয়, রাজনীতি, সমাজ কল্যাণ, দর্শন এরকম প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন। সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর অবদান যেমন অনস্বীকার্য ঠিক তেমনি শিক্ষা ক্ষেত্রেও তিনি আমাদের পথ নির্দেশ করে গেছেন বিভিন্ন ভাবে।
১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই মে (বাংলা ২৫শে বৈশাখ, ১২৬৮) জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পিতার নিকট ভারতীয় দর্শন, উপনিষদ, সংস্কৃত, জ্যোতির্বিদ্যা পাঠ করেন। তাঁর বিদ্যালয় ছিল প্রধানত গৃহ-পরিবেশ, তবুও তাঁকে কিছু সময়ের জন্য বিদ্যালয়ে যেতে হয়েছিল। প্রথাবদ্ধ বিদ্যালয়ের পরিবেশ তাঁকে কোনোদিন আকর্ষণ করতে পারেনি। সেখানে তাঁর যে অভিজ্ঞতা হয় তা অত্যন্ত নেতিবাচক যা সারাজীবন তিনি ভোলেননি, আর যার প্রতিক্রিয়ার ফসল হলো শান্তিনিকেতন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন তার জীবন দর্শন দ্বারা প্রভাবিত। তিনি তাঁর শিক্ষাদর্শনে ভাববাদ ও বাস্তববাদের মেল ঘটিয়েছেন।
শিক্ষাবিদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর শিক্ষাদর্শন:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে শিক্ষা- ‘The highest education is that which does not merely give us information but makes our life in harmony with all existence.”
অর্থাৎ-তাকেই বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, যা বিশ্ব সত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।
তিনি গতানুগতিক শিক্ষাকে তীব্র আক্রমণ করে বলেছেন, এই শিক্ষা জোর করে বাইরে থেকে চালিয়ে দেওয়া কৃত্রিম শিক্ষা, যার সঙ্গে জীবনের এবং শিক্ষার্থীর কোনো যোগ নেই। তিনি বলেন “স্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার-কলও তখন মুখ বন্ধ করেন, ছাত্ররা দুই-চার পাত কলে ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তারপর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপরে মার্কা পড়িয়া যায়।” তিনি আরও বলেছেন- দশটা হইতে চারটে পর্যন্ত যাহা মুখস্থ করি, জীবনের সঙ্গে, চারিদিকের মানুষের সঙ্গে, ঘরের সঙ্গে তাহার মিল দেখিতে পাই না। এমন অবস্থায় বিদ্যালয় একটা এঞ্জিন মাত্র হইয়া থাকে; তাহা বস্তু যোগায়, প্রাণ জোগায় না।”
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ও ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে বিশ্বসত্তার মিলনই যথার্থ শিক্ষা। শিক্ষার অর্থ শুধু জ্ঞানের সাধনা নয়, জ্ঞানের সাধনার সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতি বা সৌন্দর্যবোধের বা শিল্পবৃত্তির সাধনা এবং কর্মশক্তির বা ইচ্ছাশক্তির সাধনা। তিনি শিক্ষাকে জীবনমুখী, আনন্দময়, স্বতঃস্ফূর্ত এক প্রক্রিয়া রূপে ব্যাখ্যা করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে শিক্ষার লক্ষ্য।
রবীন্দ্রনাথের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হলো- ক) শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশসাধন খ) শিক্ষার্থীর মধ্যে সৌন্দর্যবোধের বিকাশ ঘটানো গ) প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিটি শিক্ষার্থীর সম্পর্ক স্থাপন ঘ) শিক্ষার্থীকে চিরন্তন পরমসত্তার উপলব্ধিতে সহয়তা করা।
প্রকৃতির কোলে শিক্ষা
শিক্ষাবিদ ফ্রয়বেলের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে বিশ্বে একটি ঐক্যসূত্র মানুষ, প্রকৃতি, ঈশ্বরকে এক বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। সেজন্য কতকগুলি বিষয়জ্ঞানের মধ্যে শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। সম্পূর্ণ স্বাধীন পরিবেশে বিশ্বের ঐক্যসূত্রকে উপলব্ধি করে তারই একজন হয়ে তার সঙ্গে সাযুজ্য স্থাপন করতে হবে। তিনি বলেন, “প্রকৃতির ক্রোড়ে জন্মে যদি প্রকৃতির শিক্ষা থেকে দূরে সরে থাকি, তাহলে শিক্ষা কখনও সার্থক হতে পারে না।”
রবীন্দ্রনাথের মতে পাঠক্রম (curriculum) কেমন হওয়া উচিত
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের প্রবর্তিত পাঠক্রম ছিল বিস্তৃত। তাঁর মতে পাঠক্রম হবে সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। পাঠক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যাতে নিজস্ব রুচি প্রবণতা অনুযায়ী বিকাশের সুযোগ পায় তাই তিনি পাঠক্রমের মধ্যে ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, কৃষি, কারিগরি, সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রণ, ভাস্কর্য, হস্তশিল্প ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন। এগুলোর পাশাপাশি তিনি পাঠ্যক্রমে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করছেন।
শিক্ষণ পদ্ধতি ও রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ গতানুগতিক, জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিহীন, যান্ত্রিক, পুঁথিগত কোনো শিক্ষাদান পদ্ধতির বিরোধী ছিলেন। তিনি পাঠদানের ক্ষেত্রে ভ্রমণ, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, গল্পের ছলে পাঠদান, বিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষা এবং প্রত্যক্ষ কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেছেন। তাঁর শিক্ষণ পদ্ধতি মূলত তিনটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত- ক) স্বাধীনতা খ) সৃজনাত্মক আত্মপ্রকাশের সুযোগ গ) প্রকৃতির সঙ্গে সক্রিয় সংযোগ
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতবাদ
রবীন্দ্রনাথের মতে, শিক্ষক হবেন প্রাণবন্ত মানুষ। তিনি মনে করেন, শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে আত্মীয়তার সম্বন্ধ থাকা চাই। শিক্ষকের কাজ শুধু পুঁথি থেকে শুষ্ক তত্ত্ব ও তথ্য বিতরণ নয়। শিক্ষক সবসময় আনন্দের সঙ্গে অনন্তের ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষার্থীর সমগ্র জীবন ভরে তুলবেন। শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর বন্ধু ও পথ প্রদর্শক। শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। তিনি ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘যে গুরুর অন্তরে ছেলেমানুষটি একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়েছে তিনি ছেলেদের ভার নেবার অযোগ্য। উভয়ের মধ্যে শুধু সামীপ্য নয়, আন্তরিক সাযুজ্য ও সাদৃশ্য থাকা চাই, এই যে দেনা-পাওনার নাড়ির যোগ থাকে না।’
শৃঙ্খলা: রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা দিলে তারা আপনা থেকে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়বে। তিনি বলেন “শিক্ষকদের নিজের চরিত্র সম্বন্ধে গুরুতর বিপদের কথা এই যে, যাঁদের সঙ্গে তাঁদের ব্যবহার তাঁরা ক্ষমতায় তাঁদের সমকক্ষ নয়। তাদের প্রতি সামান্য কারণে বা কাল্পনিক কারণে অসহিষ্ণু হওয়া, তাদের বিদ্রুপ করা, অপমান করা, শাস্তি দেওয়া অনায়াসেই সম্ভব। ছেলেদের কঠিন দন্ড ও চরম দন্ড দেবার দৃষ্টান্ত যেখানে প্রায়ই সেখানে মূলত শিক্ষকরাই দায়ী। তাঁরা দুর্বলমনা বলেই কঠোরতা দ্বারা নিজের কর্তব্যকে সহজ করতে চান। রাষ্ট্রতন্ত্রেই হোক আর শিক্ষাতন্ত্রেই হোক, কঠোর শাসননীতি শাসকের অযোগ্যতার প্রমাণ। ক্ষমা যেখানে ক্ষীণ সেখানে শক্তিরই ক্ষীণতা।” তাই শৃঙ্খলা রক্ষায় তিনি ছাত্র স্বায়ত্বশাসন নীতি প্রবর্তন করেছিলেন। এখানে ছাত্ররা নিজেরাই নিজেদের সংগঠনের মধ্যে দিয়ে আত্ম নিয়ন্ত্রণের ভার নিত। একে বলে ‘আত্ম নিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলা’।
শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার গুরুত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মতবাদ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। তিনি মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তিনি শান্তিনিকেতনে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য ভাবধারার সমন্বয় ঘটানোর কথাও বলেছেন তিনি। এই বিষয়গুলিকে আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার কথা বিভিন্ন শিক্ষাকমিশনের সুপারিশে রয়েছে।
ব্যবহারিক শিক্ষা
রবীন্দ্রনাথ ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি গতানুগতিক বিষয়ের সাথে হাতের কাজ, কুটির শিল্প, গ্রামোন্নয়নমূলক কাজ, অর্থনৈতিক উন্নয়নয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। শিক্ষাকে তিনি কর্মমুখী করে তোলার ওপর আগ্রহী ছিলেন।
বিশ্বভারতী
রবীন্দ্র শিক্ষা ভাবনার প্রায়োগিক শ্রেষ্ঠ অবদান বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে বীরভূমের বোলপুরে শান্তিনিকেতনে আশ্রমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালের শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়কে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয় ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন- “প্রথমে আমি শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় স্থাপন করে এই উদ্দেশ্যে ছেলেদের এখানে এনেছিলুম যে বিশ্ব প্রকৃতির উদারক্ষেত্রে আমি এদের মুক্তি দেব। কিন্তু ক্রমশ আমার মনে হল যে, মানুষে মানুষে যে ভীষণ ব্যবধান আছে, তাকে অপসারিত করে মানুষকে সর্বোমানবের বিরাট লোকে মুক্তি দিতে হবে।” এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নতুন নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন, সৃজন জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্মোচন। তিনি বিশ্বভারতীর মাধ্যমে তিনি প্রাচ্যের জ্ঞান ও সত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বাণী বিশ্বে ছড়াতে ব্রতী হলেন এবং বিদেশের জ্ঞান বিজ্ঞান সঠিকভাবে এখানে পৌঁছনোর জন্য ওখানকার নামী অধ্যাপকের সমাগম ঘটালেন। তিনি বলেছিলেন- “যেখানে সারা বিশ্ব একত্রে বাস করবে’ (যত্র বিশ্বম ভবত্যেক নীড়ম্’)। সেই কারণে বিশ্বভারতী দেশ ও জাতির গন্ডি পার করে বিশ্বভারতী আজ বিশ্বমানবের তীর্থভূমি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্ত দিকেই কিছু না কিছু প্রভাব বিস্তার করেছে। অধ্যাপক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ বলেছেন-Rabindranath Tagore was undoubtedly the greatest leader of the Indian Renaissance and his influence was felt in all of our cultural life. Education did not escape it.