শায়লা ইসলাম নীপা
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের নাম কম-বেশি সবারই জানা। জানা থাকবেই না কেন, জ্ঞানের এমন কোনো শাখা খুঁজে পাওয়া মুশকিল যেখানে এই বিখ্যাত দার্শনিকের দৃষ্টি পড়েনি। দর্শন থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা, রাজনীতিবিদ্যা, নীতিবিদ্যা নন্দনতত্ত্ব- এক কথায় জ্ঞানের সকল শাখাতেই তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
অ্যারিস্টটলের রচনাসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি নীতিশাস্ত্রমূলক গ্রন্থ হলো নিকোমেকিয়ান এথিক্স। এ গ্রন্থটিতে তিনি দৈনন্দিন জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট নীতিবিদ্যক বিষয়গুলো অত্যন্ত নিখুঁত ও সুনিপুণভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন। তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দার্শনিক লেখনীর কারণে বর্তমান সময়ে এসেও তাঁর চিন্তাধারা বিন্দুমাত্র আবেদন হারায় নি। বরং আমাদের সামনে চিন্তার নতুন নতুন দ্বার উন্মোচন করে এবং বাস্তব জীবনের পরিস্থিতিগুলোকে মোকাবেলা করতে পথপ্রদর্শনের ভূমিকা পালন করে। নিকোমেকিয়ান এথিক্স গ্রন্থটি রচনার প্রেক্ষাপট নিয়ে যদিও অনেকের ভিন্নমত রয়েছে তবুও ধারণা করা হয়, গ্রন্থটিতে উল্লিখিত নীতিকথাগুলো হয় অ্যারিস্টটল তাঁর বাবার নিকট থেকে পেয়েছিলেন কিংবা তাঁর একমাত্র ছেলে নিকোমেকাসকে উপদেশ দিয়েছিলেন। আর একারণেই গ্রন্থটির বিষয়বস্তু খুব জীবন্ত মনে হয়। দশটি পুস্তক সম্বলিত এ গ্রন্থটির অষ্টম ও নবম পুস্তকে ‘বন্ধুত্ব’ নামক মহার্ঘ্য বস্তুটির আলোচনা রয়েছে।
বন্ধুত্ব সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের বিখ্যাত উক্তি- “A friend is a second self” থেকেই অনুমান করা যায় অ্যারিস্টটল বন্ধুত্বকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। জীবনে চলার পথে আবশ্যকীয় বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে বন্ধু। যে কোনো পরিস্থিতিতে- ভালো সময়, খারাপ সময় এমনকি ধনী-গরিব সকলেরই বন্ধুর প্রয়োজন। পশু পাখিরও বন্ধুর প্রয়োজন হয়ে থাকে। আর এ বন্ধুত্বের মাধ্যমেই সমাজের সাথে সমাজের, রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। অ্যারিস্টটলের মতে, বন্ধুত্ব অত্যাবশ্যকীয় তো বটেই, তবে এটি আরো মহৎ কিছু হওয়ার দাবিদার। বন্ধুত্বকে অনেকেই অনেকভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে। কারো মতে, সমরূপতাই বন্ধুত্ব, কেউ বা আবার বৈপরীত্যকেই বন্ধুত্বের কারণ বলে থাকেন। মোট কথা, বন্ধুত্ব নিয়ে-অভিমতের কোনো শেষ নেই। কিন্তু যত মতভেদই থাকুক না কেন বন্ধুত্ব যে আবশ্যক এবং পরম কামনার বস্তু সেই ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। বন্ধুত্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো পারস্পরিক ভূমিকা। বন্ধুত্ব বিভিন্ন কারণে, বিভিন্নভাবে হতে পারে। প্রত্যেকটি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পেছনে যে মুখ্য উপাদানগুলো কাজ করে তার প্রেক্ষিতে অ্যারিস্টটল বন্ধুত্বের ২টি প্রকারের কথা বলেন। এগুলো হলো: উপযোগিতার খাতিরে বন্ধুত্ব (Friendship for Utility), সুখপ্রদানকারী বন্ধুত্ব (Friendship for Pleasure) ও পূর্ণাঙ্গ বা সদগুণসম্পন্ন বন্ধুত্ব (Complete or Virtuous Friendship).
উপযোগিতার খাতিরে বন্ধুত্বটি প্রায়শই এরকম যে বন্ধুত্বটি হয়ে থাকে কেবল একজন অপরজনের প্রয়োজন বলে। এ ধরনের বন্ধুত্বটি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কিংবা কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণ না হলে আপনাতেই বন্ধুত্ব ভেঙ্গে যায়। আবার সুখদায়ক বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে একে অপরকে কামনা করে এজন্য যে তারা একে অপরের থেকে সুখ লাভ করে থাকে। একসময় পরস্পরের সুখের প্রকৃতি ভিন্ন হয়ে যায়, তখন বন্ধুত্বেও পরিবর্তিত হয়। এ ধরনের বন্ধুত্ব যেমন খুব তাড়াতাড়ি গড়ে ওঠে, আবার খুব তাড়াতাড়ি ভেঙ্গেও যায়। এজন্যই তরুণ বয়সের ছেলে মেয়েদের মধ্যে অল্প সময়ে প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায় এবং খুব দ্রুত সম্পর্কটি ভেঙ্গেও যায়। পূর্ণাঙ্গ বা সদগুণসম্পন্ন বন্ধুত্ব তাদের মধ্যেই হয়ে থাকে যারা সদগুণের ধারক ও বাহক। তারা একে অন্যের শুভ কামনা করে কোনো প্রয়োজনীয়তা কিংবা সুখপ্রাপ্তির জন্য নয়, বরং বন্ধুত্বের খাতিরেই; আর যেহেতু সদগুণ একটি দীর্ঘস্থায়ী চারিত্রিক অবস্থান বোঝায় সেহেতু এ ধরনের বন্ধুত্বটি দীর্ঘস্থায়ী হয়। যখন উভয়েই একে অন্যের ভালোবাসার যোগ্য হয় তখনই এ বন্ধুত্বটি হয়। যদিও এ ধরনের বন্ধুত্ব খুব কমই দেখা যায়। কারণ দ্রুত বন্ধু হয়ে যায় আমাদের প্রবণতার মধ্যে রয়েছে, আর এটা হয় আমরা শুধুই বন্ধু হতে চাই বলে। এতে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর বন্ধুত্বের সম্পর্কটি শিথিল হতে শুরু করে। তবে, একসাথে একটা দীর্ঘসময় অতিবাহিত করার পর যখন একজন অপরজনের চারিত্রিক অবস্থানকে ভালোবাসার যোগ্য বলে মনে করবে তখনই পূর্ণাঙ্গ বন্ধুত্বটি হয়। এ বন্ধুত্বটি গড়ে উঠতে সময়ের প্রয়োজন।
বন্ধুত্বে পারস্পরিক সমতা আনয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রয়োজনীয়তা ও সুখপ্রাপ্তির ভিত্তিতে বন্ধুত্বে সমতা রক্ষা করা হয় চাহিদার ভিত্তিতে এবং পূর্ণাঙ্গ বন্ধুত্বে মর্যাদা বা যোগ্যতার ভিত্তিতে। যারা সমমানসম্পন্ন তাদের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আদান-প্রদান ঘটে থাকে যার যার প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে এক্ষেত্রে একজন অপরজনের থেকে বেশি কিছু কামনা করে থাকে এবং এজন্য এতে অভিযোগও স্থান পায়। আবার সুখপ্রদ বন্ধুত্বটি ততক্ষণই টিকে থাকে যতক্ষণ সুখ পাওয়া যায়, তবে পূর্ণাঙ্গ বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে দুজন ভালো মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হয় সদগুণের উপস্থিতি। সমমানসম্পন্ন বন্ধুত্বটি টিকিয়ে রাখতে এ ব্যাপারটি বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখে যে একজন বন্ধু অপরজন থেকে যা প্রাপ্ত হবে বিনিময়ে সেই পরিমাণেই পরিশোধ করবে।
কিছু বন্ধুত্ব রয়েছে যেগুলো ব্যক্তির মর্যাদার দিক থেকে অসম হয়। এ বন্ধুত্বগুলোতেও সমতা আনয়ন করতে হয়। যেমন: পিতা-মাতা ও সন্তান, শিক্ষক ও ছাত্র, শাসক ও শাসিত এদের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক সেখানে মর্যাদার ক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থান রয়েছে। এ ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি মোটেও কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো হবে না যে, যে যত বেশি বিনিয়োগ করবে, সে তত লাভ করবে। এক্ষেত্রে প্রাপ্তির পরিমাণ ও ধরন হয় ভিন্ন রকমের। যারা মূলত উচ্চ অবস্থানে রয়েছে যেমন- পিতা-মাতা, শিক্ষক, শাসক তারা তাদের যোগ্যতা অনুসারে কর্মবিধি পালন করে কিংবা ভালোবাসা প্রদান করে। আর যারা বিপরীত অবস্থানে থাকে সন্তান, ছাত্র, শাসিত তারা চাইলেই সঠিক পরিমাণে প্রতিদান দেওয়া সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে পারস্পরিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে পরিমাণ গুরুত্ব পায় না, যার যার অবস্থান কিংবা যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। যেমন কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তি তার গরিব বন্ধুটিকে সাহায্য করলে বিনিময়ে আরো বেশি প্রত্যাশা করবে না, বরং প্রতিদানে সে লাভ করবে উচ্চতর মর্যাদা বা সম্মান এবং এজন্য গরিব বন্ধু আর্থিক সাহায্য পাবে। ঠিক এজন্য উচ্চতর মর্যাদার কারণেই কিছু অধিকারও বেশি থাকে। পিতা-মাতা সন্তানকে ত্যাজ্য করার, শিক্ষক তার ছাত্রকে শাস্তিপ্রদানের অধিকার রাখে, যা কোনো সন্তান বা ছাত্রের নেই। এভাবে যোগ্যতার ভিত্তিতেই দুই পক্ষের মধ্যে সমতা আনা হয়।
বন্ধুত্ব যে সব সময়ই মধুর হয় তা নয়, বন্ধুত্বে জটিলতা সৃষ্টি হয়। কিছু বন্ধুত্ব মনে বিরূপ প্রভাবও ফেলে। অ্যারিস্টটলের প্রথম দুই ধরনের বন্ধুত্ব যে সাময়িক এবং একসময় ভেঙ্গে যাবে এটা নতুন কিছু নয়। আবার পূর্ণাঙ্গ বা সদগুণের প্রেক্ষিতে বন্ধুত্বও ভাঙ্গে না তা নয়। এক সময় এ ধরনের বন্ধুত্বও প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যখন তাকে অপরজনে বোঝাতে সক্ষম হয় যে বন্ধুত্বটি সদগুণের প্রেক্ষিতেই হয়েছে কিন্তু পরে প্রমাণিত হয় প্রয়োজনে বা সুখ প্রাপ্তির কারণে হয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে যদি বন্ধুটি তার উদ্দেশ্য পরিবর্তন করে সদগুণসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে তখন বন্ধুত্বটি টিকতেও পারে। আবার একটি ব্যাপার ঘটে যে ছোটোবেলায় সমান মানসিকভাবে দুই বন্ধু বড় হয়ে একজন অপরজনকে সদগুণে ছাড়িয়ে যায়, সেক্ষেত্রেও বন্ধুত্বটা ভেঙ্গে যেতে পারে। আবার দীর্ঘ যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাও কোনো ভালো বন্ধুত্বকে ভেঙ্গে দিতে পারে।
বন্ধুত্বের উপস্থিতি কোনো স্থান-কাল পাত্রভেদে হয় না। বরং বন্ধু প্রয়োজন সকল ক্ষেত্রে, সকল অবস্থাতেই। দুঃখের সময়ে বন্ধুর উপস্থিতি যেমন দুঃখকে প্রশমিত করে। তেমনি সুখের সময়ও বন্ধুর উপস্থিতি সুখকে দ্বিগুণ করে তোলে। অনেকের ধারণা এমন যে, পরিপূর্ণ সুখী অবস্থায় হয়তো কারো বন্ধুর প্রয়োজন হয় না কারণ তখন ব্যক্তির প্রয়োজনের ও সুখের সবকিছু তার নিজের কাছেই রয়েছে। তবে এরূপ ধারণা ঠিক নয়। মানুষ যতই সুখী হোক না কেন তার বন্ধুর প্রয়োজন হবেই। মানুষ যতই সম্পদ ভোগ করতে আগ্রহী হোক না কেন যদি তাকে পুরো পৃথিবীর সম্পদ একা ভোগ করার অধিকার দেওয়া হয় যেখানে যে একা বাস করবে সেটা তার পক্ষে কখনো সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুখী ব্যক্তিটিও সদগুণের কারণে একজন বন্ধুর সান্নিধ্যে যায়। বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে এসে বন্ধুর পরিমাণ অগণিত, কিন্তু বন্ধুত্বগুলোর ভিত্তিটা কতটুকু মজবুত? আমরা কি দিন প্রয়োজনীয় কিংবা সুখপ্রদানকারী বন্ধুত্বগুলোর দিকেই ধাবিত হচ্ছি না? বন্ধুত্ব তো চলতে ফিরতে প্রতিদিনই গড়ে উঠছে। কিন্তু ভালো বন্ধুর সংখ্যা কি বৃদ্ধি পাচ্ছে? কথায় আছে যে সকলের বন্ধু হয় সে কারোর ভালো বন্ধু হয় না। এ জন্যই হয়তো অ্যারিস্টটল বন্ধুর সংখ্যা সীমিত করণের কথা বলে গেছেন। বন্ধুর সংখ্যা অধিক হওয়া সমীচীন হয় না সবসময়, এমনকি বাড়তি আতিশয্য মহৎ জীবনকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে। এক্ষেত্রে যদিও বন্ধুত্বের কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই তবু সেই পরিমাণ বন্ধু থাকা উচিত যাদের সাথে সবসময় যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভবপর হয়। সেক্ষেত্রে অধিক বন্ধু কামনা না করে ভালো বন্ধুত্ব কামনা করা উচিত। আবার প্রেমিক-প্রেমিকার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন ভালোবাসার পর্যায়টি যেহেতু বন্ধুত্বেরই আধিক্য বোঝায় সেহেতু এক সময়ে এক ব্যক্তির জন্যই অনুভব করা যায়। এজন্য বিখ্যাত সব বন্ধুত্বগুলো দুইজন বা সীমিত লোকের মধ্যেই হয়ে থাকে।
অ্যারিস্টটলের মতের আলোকে বর্তমান পরিস্থিতিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বন্ধুত্ব এবং অল্প বয়সীদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কগুলো খুব তাড়াতাড়ি একটি পরিণতি পেতে হয়। এক্ষেত্রে উপযোগিতা কিংবা সুখপ্রাপ্তির তাড়নাও থাকে, সম্পর্কগুলো আবার খুব সহজেই ভেঙ্গে পড়ে যা আজকের সমাজে অহরহ ঘটে যাওয়া চিত্র। অবশ্য এর ব্যতিক্রম যে নেই তাও বলা যায় না, তবে সে সম্পর্কগুলো বিরল। বন্ধুত্ব হোক বা প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কে হোক তারা যদি নিজেদের এমন এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারে যেখানে প্রয়োজন কিংবা সুখ প্রাপ্তি মুখ্য না হয়ে বরং পরস্পর পরস্পরের চারিত্রিক অবস্থানকে ভালোবাসবে, দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে। তখনই সে সম্পর্কগুলোতে দৃঢ়তা আসবে যা হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং যা সকল মন্দের উদ্ভবের বিনাশ ঘটাতে সক্ষম হবে।