চট্টগ্রাম সংবাদদাতা: বুলবুল আক্তার। ২০০১ সালের ১লা জানুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় মারা যান মা। দুই বছর পর হারান বাবাকে। স্থানীয় একজন তাকে লালনপালন করে। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধিতা দেখা গেলে পরে তিনি লালনপালনে অনীহা প্রকাশ করেন। ২০০৪ সালে স্থানীয় এক মহিলা তাকে শিশুস্বর্গে এনে দেন। বর্তমানে বুলবুল চট্টগ্রাম নগরের সিটি করপোরেশন আজিজুর রহমান হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। এভাবে কেবল বুলবুল নন, সমাজের অসহায়, গরিব, পথহারা ও বঞ্চিত শিশুদের স্থান হচ্ছে শিশুস্বর্গে। বর্তমানে এখানে আবাসিক, অনাবাসিক ও শিক্ষার্থী মিলে ২৫০ জন শিশু আছে। কানাডিয়ান দম্পতি ফ্রেড ও বনি কাপাচিনো ২০০২ সালে স্বল্প পরিসরে পথহারা মাত্র ছয়জন শিশু নিয়ে যাত্রা শুরু করেন শিশুস্বর্গের। তাদের চিন্তায় ছিল অবহেলিত, অসহায়, দরিদ্র ও বঞ্চিত শিশুদের জন্য কিছু করার। বাংলাদেশে এসে এমন শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন শিশুস্বর্গ। শিশুস্বর্গের শিশুরা তাঁকে ডাকে বনি মা বলে। চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলীর বার কোয়ার্টার এলাকার আনজুমান ভবনে শিশুস্বর্গ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশি ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন সেলিমের পৈতৃক সম্পত্তি আনজুমান ভবনেই চলছে শিশুস্বর্গের কার্যক্রম। শিশুস্বর্গের তিনতলা ভবনটিতে আছে লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব, মুনতাসির স্কুল (খেলার ছলে পাঠদান)। বাচ্চাদের জন্য আছে নাচ, গান, ড্রইং, তবলা শেখার ব্যবস্থা।
শিশুস্বর্গের কার্যনির্বাহী কমিটির মহাসচিব সৈয়দ মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন বলেন, আমরা মনে করি শিশুস্বর্গটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সব ধর্মের শিশুর সহাবস্থান। সবাই একসঙ্গে থাকে। কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। শিশুস্বর্গের কো-অর্ডিনেটর জেসমিন আরা বলেন, শিশুস্বর্গ কার্যত পথহারা, অসহায়, গরিব ও বঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখার মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসার মতো উপযোগী করে তোলে। এখানে থেকে এবং লেখাপড়া করে তারা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি। এখানে বঞ্চিত শিশুদের স্বপ্ন দেখানো হয়, সঙ্গে স্বপ্ন বাস্তবায়নও করা হয়। শিশুস্বর্গের সহকারী ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ফরহাদ হোছাইন বলেন, এখানে থেকে পড়ালেখা করে অন্তত অর্ধশত শিশু এখন প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে একজন সাউথ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের পক্ষে টেবিল টেনিস খেলে স্বর্ণপদকও অর্জন করে। তাছাড়া এখানে থেকে পড়ালেখা করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পল্লী বিদ্যুৎ, হেলথ টেকনোলজি, গার্মেন্টের পদস্থ পদ, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি করছেন। জানা যায়, ২০০২ সালে স্বল্প পরিসরে পথহারা মাত্র ছয়জন শিশু নিয়ে যাত্রা শিশুস্বর্গের। বর্তমানে প্রায় ২৫০ জন শিশু এখানে আছে। আবাসিক ৬৪ জন। এর মধ্যে বালক ২৭ ও বালিকা ৩৭ জন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ছে ৬৪ জন, হেলথ টেকনোলাজিতে পড়ে দুজন, হোমিও কলেজে পড়ে একজন, ঢাকা বিকেএসএফে পড়ে দুজন, বিনামূল্যে অনাবাসিক শিশু শিক্ষার্থী আছে ১২২ জন ও পড়ালেখায় সাপোর্ট দেওয়া হয় ৪৫ জনকে। স্কুলশিক্ষক আছেন ছয়জন, সাপ্তাহিক শিক্ষক আছেন চারজন ও আবাসিক কর্মকর্তা আছেন ১০।
কানাডিয়ান ওই দম্পত্তির বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরও আটটি প্রতিষ্ঠান আছে। ১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশে এসে ১৯ জন যুদ্ধশিশুকে কানাডায় নিয়ে যান। এর মধ্যে একজনকে নিজের কাছে রেখে বাকিদের বিভিন্ন দম্পতির কাছে দত্তক দেন। নিজের দুই সন্তান ছাড়াও তাদের কাছে মানুষ হয়েছে ১৯ জন শিশু। তিনি বাংলাদেশে প্রতি তিন মাস পরপর আসেন। সময় দেন বাচ্চাদের।