তানিয়া জেরিন খুশবু: অটিজমকে স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের পরিপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটি বহু বছর ধরে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন শিশুর ওপর সামাজিক, মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে আসছে। ১৯৪৩ সালে লিও ক্যানার নামে একজন চিকিৎসক অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের একটি গ্রুপ নিয়ে বিবরণ প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে বিশেষভাবে নিম্নলিখিত উপসর্গ লক্ষ্য করা যায়।
১. দুর্বল বা সম্পূর্ণভাবে সামাজিক ভাব আদান-প্রদানের অভাব দেখা যায়, ২. একই ধরনের বা একইভাবে কাজ করার বা খেলার প্রবণতা দেখা যায়, ৩. কথা কম বলা বা বলতে না পারা অথবা একই শব্দ বারবার উদ্দেশ্যবিহীনভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা, ৪. পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে কথা বলার চেষ্টা, ৫. নতুন জায়গা বা নতুন পরিবেশ বা নতুন ব্যক্তির সান্নিধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ প্রদর্শন করা বা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা, ৬. কোনো কারণ ছাড়া অতিরিক্ত রাগ প্রদর্শন করা, ৭. কখনো খেলাধুলা বুঝতে বা খেলাধুলার নিয়ম অনুসরণ করতে অসুবিধা হওয়া, ৮. কোনো কোনো শিশুর ক্ষেত্রে অক্ষর চিনতে এবং লিখতে সমস্যার সম্মুখীন হওয়া, ৯. চোখে চোখ রেখে কথা বলতে অসুবিধা বা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা।
বর্তমানে যাদের ক্ল্যাসিক বা ক্যানারের অটিজম সংস্করণ নিয়ে চিহ্নিত করা হয়, তাদের মধ্যে একাকী থাকার প্রবণতা, খেলাধুলা, ভাষাগত ও ভাবের আদান-প্রদানের দক্ষতার অভাব, কোনো ধরনের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা, কিংবা ভীষণ রকমের পরিবর্তন-প্রতিরোধী মনোভাব পরিলক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
যদিও চারিত্রিক ভিন্নতার কারণে অটিজমে আক্রান্ত শিশু বৈশিষ্ট্যগত বিচারে একে অপরের থেকে আলাদা হতে পারে, তা সত্ত্বেও তাদের সবার মধ্যে একই ধরনের সুসংজ্ঞায়িত কিছু অসুবিধা বিদ্যমান থাকতে পারে। এটি ট্রায়াড অব ইম্পেয়ারমেন্ট নামে পরিচিত: ১. ভাবের আদান-প্রদানে বিকলতা: অন্যদের সঙ্গে অনুপযুক্তভাবে ভাবের আদান-প্রদান করা এবং সামাজিকভাবে অমিশুক ও অস্বস্তিকর হিসেবে উপস্থাপন করা এবং সামাজিক মেলামেশা এড়িয়ে বিচ্ছিন্ন থাকতে চাওয়ার মনোভাব; সম্পর্কের দ্বিমুখী প্রকৃতির ব্যাপারে খুব সীমিত ধারণা থাকা। ২. সামাজিক ভাষা ও যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা: ভাষার বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার (যেমন: কৌতুক বা উপমা) বুঝতে অসুবিধা হওয়া এবং না বুঝে মত প্রকাশের প্রবণতার মাধ্যমে ভাষা বিকাশের ব্যর্থতা প্রকাশ পায়। ইশারা ও আকার-ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হওয়া। ৩. চিন্তা ও কল্পনার নমনীয়তার প্রতিবন্ধকতা: পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ এবং খেলার প্রতি আগ্রহ; সুস্পষ্ট পরিবর্তন-প্রতিরোধী মনোভাব এবং দক্ষতা বা জ্ঞানকে সর্বজনীন রূপে গ্রহণ করতে অসুবিধা হওয়া।
এই ক্ষেত্রগুলো ছাড়াও বিশেষ করে যারা অটিজমে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে মনে করা হয় প্রতিবন্ধকতার একটি চতুর্থ দিক রয়েছে। ১. সংবেদনশীলতা প্রক্রিয়াকরণ এবং পেশি সঞ্চালনগত দক্ষতার প্রতিবন্ধকতা: সংবেদনশীলতা সংক্রান্ত (ব্যথাসহ অন্যান্য) অভিজ্ঞতার মধ্যে তারতম্য এবং পেশি সঞ্চালনের ক্ষেত্রে সূক্ষ সমন্বয়ের অভাব। অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই নিম্নোক্ত অসুবিধাগুলোর শনাক্তকরণকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
১. ব্যাপকতা, অর্থাৎ, এটি একটি শিশুর জীবনের সমস্ত দিককে প্রভাবিত করে; ২. বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত, অর্থাৎ, এই সমস্যাটি শৈশব থেকে শুরু হয় (তিন বছর বয়সের আগ থেকেই সমস্যার লক্ষণগুলো শুরু হয়) এবং মানসিক ও শারীরিক বিকাশের সমস্ত দিককে প্রভাবিত করে; ৩. আজীবন প্রভাব: অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারকে একটি নিরাময়যোগ্য রোগ হিসেবে ভাবা উচিত নয়, বরং ভাবা উচিত, একজন অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত শিশুকে কীভাবে তার সম্ভাবনার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিতে সক্ষম করা যায়। এখন পর্যন্ত অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের কারণ সম্পূর্ণরূপে জানা বা বোঝা যায়নি, তবে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে।
প্রথমত, সমস্যার প্রারম্ভিক অবস্থায় একজন অটিস্টিক শিশুর রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখনই বাবা-মায়ের শিশুর মানসিক বা সামাজিক অথবা আচরণগত কোনো সমস্যার সন্দেহ হবে, তৎক্ষণাৎ শিশুকে একজন সাইকোলজিস্ট দ্বারা পর্যবেক্ষণ করানো অত্যন্ত প্রয়োজন। একজন অটিজমে আক্রান্ত শিশুর অল্প বয়স থেকে যদি পর্যাপ্ত থেরাপি যেমন-স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং বিভিন্ন শিশুর সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়া যায়, সেক্ষেত্রে শিশুর দ্রুত উন্নতি আশা করা যেতে পারে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে একজন অটিস্টিক শিশুকে নানাভাবে সাহায্য করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, অটিস্টিক শিশুর শেখানোর পদ্ধতি অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর থেকে ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে ছবির মাধ্যমে বা দর্শনের মাধ্যমে কোনো তথ্য প্রদান করলে শিশুটি তা সহজভাবে বুঝতে পারে এবং মনে রাখতে পারে। আরো উল্লেখযোগ্য, এ ধরনের শিশুর সঙ্গে কথোপকথনের সময় জটিল শব্দ এড়িয়ে চলা উচিত। সহজ-সাবলীল শব্দ এবং ছোট বাক্যে এ ধরনের শিশুকে উৎসাহিত করে কথা বুঝতে এবং তার উত্তর দিতে। যেহেতু এ ধরনের শিশুর হাত এবং পায়ের মাংসপেশির জড়তা, দুর্বলতার কারণে তারা খেলাধুলা বা লেখার প্রতি মাঝে মাঝে চরম অনীহা প্রকাশ করে, সেক্ষেত্রে অটিজমে আক্রান্ত বিভিন্ন খেলাধুলা যেমন-সাঁতার, সাইকেল, ফুটবল, চিত্রাঙ্কন, ধাঁধাসংক্রান্ত সমাধান খেলা, একজন বয়স্কের তত্ত্বাবধানে সহজ-সাবলীলভাবে শেখানো উচিত।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের বিশেষ খাদ্যতালিকা। যেহেতু এ ধরনের শিশুরা অনেকটা চঞ্চল হয়ে থাকে এবং এদের যে কোনো কাজে মনোযোগ ধরে রাখা কষ্টকর হয়, সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যতালিকা নির্বাচন একটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন-চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার পরিহার বা কম মাত্রায় দেওয়া। অনেক অটিজমে আক্রান্ত শিশু গম, দুধ বা এজাতীয় জিনিস দ্বারা তৈরি খাদ্যে অনেকভাবে আক্রান্ত হয়ে থাকে, যা কিনা তাদের শারীরিক এবং মানসিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সঠিক খাদ্যতালিকা নির্ধারণ এবং শিশুটি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাচ্ছে কি না, তা গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
পরিশেষে অটিজম একটি মানসিক ব্যাধি, যা কিনা একটি শিশুর সুস্থ বিকাশে নানাবিধ অসুবিধা নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু সঠিক সময়ে চিকিৎসা ও সহায়তার মাধ্যমে এ ধরনের শিশুও আস্থার সঙ্গে সামাজিক প্রতিষ্ঠা পেতে পারে, একটি উন্নত ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান হতে পারে।