বাণিজ্য ডেস্ক: চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল, মধ্যরাত। কুমিল্লার হোমনা পৌরসভার বাগমারা গ্রামের আবদুর রশীদের বাড়ি। উঠানের পাশে টিনের চালের নিচে বাঁধা চারটি গরু ও একটি বাছুর। প্রচণ্ড গরমে ওই রাতেই সব গরু মারা যায়। বেঁচে থাকে শুধু দুই মাস বয়সী বাছুরটি। গরুর মালিক সাদ্দাম হোসেন একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি। সাদ্দামের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, তার স্বামী আবদুর রশীদ বেঁচে নেই, ছোট ছেলেটি স্পষ্ট কথা বলতে পারে না, বুদ্ধিশুদ্ধি কম বলে কোথাও কাজ পায় না। তাই ভাইয়েরা মিলে কিছু টাকা দিয়ে এ গরু চারটি কিনে দিয়েছিল। এখন তার না আছে গরু, না আছে পুঁজি। গবাদি পশু হারিয়ে একটি পরিবারের পথে বসে যাওয়ার এ চিত্র শুধু হোমনার বাগমারা নয়, সারা দেশেই দেখা যায়। কখনো হিটস্ট্রোক, কখনো বিষাক্ত খাবার খেয়ে, কখনো আবার ভাইরাস কিংবা রোগে আক্রান্ত হয়ে একসঙ্গে মরে যাচ্ছে খামারের গরু। সর্বস্বান্ত হচ্ছেন প্রান্তিক খামারির অনেকেই।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি অনুষদের বিভাগীয় প্রধান ড. হাসনিন জাহান বলেন, বাংলাদেশের কৃষিতে প্রাণিসম্পদ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভাবনাময় খাত। আর এ খাতের বিকাশে ভূমিকা রাখছে প্রান্তিক খামারিরা। অথচ তারাই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ ঝুঁকিতে। ড. হাসনিন জাহান বলেন, ‘উন্নত দেশে গবাদি পশুর খামারিরা একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ পান। তাদের পশুগুলো বিমা করা থাকে। পুঁজির জন্য ব্যাংকঋণ পান। বাংলাদেশে বড় খামারিরা কিছু ক্ষেত্রে এ সুবিধা পেলেও ছোট ছোট গ্রামীণ খামারি তা থেকে বঞ্চিত। আমরা যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কথা বলছি, প্রাণিসম্পদ খাতে এটি নিশ্চিত করতে হবে।’
বিমাসুবিধা নেই প্রান্তিক পর্যায়ে: বাংলাদেশের কৃষিজ জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৩.৬০ শতাংশ (বিবিএস, ২০২১)। দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের প্রত্যক্ষ এবং প্রায় ২০ শতাংশ মানুষের পরোক্ষ কর্মসংস্থানের উৎস প্রাণিসম্পদ খাত। ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৪৭ লাখ। ছাগল ২ কোটি ৬৭ লাখ ৭৪ হাজার ও মহিষ ১৫ লাখ ৮ হাজার। বিপুল পরিমাণ এ প্রাণিসম্পদের ১ শতাংশও বিমাসুবিধার আওতায় আসেনি এখনো। ঝুঁকিপূর্ণ ভেবে ব্যাংক গবাদি পশু ঋণে এগিয়ে আসছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে পশুবিমায় এগিয়ে এসেছে। এর মধ্যে গ্রিনডেল্টা, সেনাকল্যাণ, ইউনিয়ন, নিটল ও ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স উল্লেখযোগ্য। এছাড়া গবাদি পশু খামারে ঋণ সুবিধা দিচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড। কিছু বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে এলেও প্রাণিসম্পদ খাতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি এখনো সীমিত পরিসরেই রয়ে গেছে। পাশের রাষ্ট্র ভারত এমনকি নেপাল প্রাণিসম্পদ বিমায় এগিয়ে গেলেও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ভারতে ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে সরকারি তত্ত¡াবধানে একটি বিশেষ হাইব্রিড মডেলের মাধ্যমে ১০০ প্রশাসনিক জেলায় ‘লাইভস্টক ইন্স্যুরেন্স স্কিম’ চালু রয়েছে। নেপালে কমিউনিটি লাইভস্টক ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় খামারিদের প্রিমিয়ামের ৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি দেয়। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)-এর মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)-এর সহায়তায় কিছু ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রাণিসম্পদ বিমা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে প্রান্তিক পর্যায়ে পশুবিমা সম্প্রসারণে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। খামারিরাও এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন নন। ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের এমডি রফিকুর রহমান বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আগে নিশ্চিত হতে চায়, যে পশুটির বিপরীতে ঋণ দেবে তা রোগমুক্ত কি না, বিমা করা আছে কি না। এছাড়া পশুটি যাতে হারিয়ে না যায়, কেউ যেন বিক্রি করে না ফেলে সেজন্য এর অবস্থান শনাক্তকরণ প্রযুক্তি দরকার। তিনি বলেন, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে বিমাসুবিধা ছড়িয়ে দিতে গেলে ‘স্মার্ট লাইভস্টক’ কার্যক্রম জরুরি। ‘স্মার্ট লাইভস্টক, স্মার্ট বাংলাদেশ’ ¯েøাগানে গবাদি পশুর ডিজিটালাইজেশনে এগিয়ে এসেছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি)। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে গৃহীত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। এলডিডিপির চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী বলেন, সারা দেশের গবাদি পশুর ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রতিটি পশুর রং, জাত, জন্ম উৎস, খাদ্যাভ্যাস, রোগসহ প্রয়োজনীয় সব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ তথ্য একটি শনাক্তকরণ নম্বরের মাধ্যমে বারকোডে দেওয়া থাকবে। ওই বারকোডটি পশুর কানে ট্যাগ দিয়ে লাগানো থাকবে। এর ফলে ব্যাংক, বিমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বারকোড স্ক্যান করে যে কোনো পশু সম্পর্কে মুহূর্তেই যাবতীয় তথ্য পেয়ে যাবে।