শামসুল আরেফিন হযরত শেখ ফরিদুদ্দিন মাসউদ গঞ্জেশকর (রহ.)

শামসুল আরেফিন হযরত শেখ ফরিদুদ্দিন মাসউদ গঞ্জেশকর (রহ.)

ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান: শামসুল আরেফিন হযরত শেখ ফরিদুদ্দিন মাসউদ গঞ্জেশকর (রহ.) ৫৬৯ হিজরি ১১৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ২৯শে শাবান পাকিস্তানের মুলতানে খাটোয়াল নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হযরত জামালুদ্দিন (রহ.) এবং মাতার নাম হযরত সবুরা খাতুন (রহ.)। তাঁর ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ ছিলেন কাবুল রাজ্যের বিখ্যাত অলীয়ে কামেল হযরত ফররুখ শাহ্ (রহ.)। তাঁর পিতা হযরত জামালুদ্দিন (রহ.) এলমে শরিয়ত ও এলমে মারেফতের অধিকারী একজন কামেল বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর পিতা মুলতানের প্রখ্যাত মাওলানা হযরত ওয়াজিহুদ্দিন খাজান্দি (রহ.)-এর কন্যা সবুরা খাতুন (রহ.)-কে বিয়ে করেন। তাঁদের ঘর উজ্জ্বল করে তিন পুত্র যথাক্রমে হযরত ফরিদুদ্দিন মাসউদ (রহ.), হযরত আজুদ্দিন মাহ্মুদ (রহ.) ও হযরত নাজিবুদ্দিন মুতাওয়াক্কেল (রহ.) এবং কন্যা বিবি হাজেরা (রহ.) জন্ম গ্রহণ করেন।

হযরত ফরিদুদ্দিন (রহ.)-এর জন্মকে ঘিরে কিছু অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। তাঁর জন্মের সময় রাত্রি মেঘলা হওয়ায় মানুষ জানতে পারেনি রমজান শুরু হয়েছে কি না। কিন্তু একজন সুফি দরবেশ তাদের বলেছিল যে, একজন অলী-আল্লাহ্ জন্ম গ্রহণ করেছেন। একদিনের শিশু ফরিদুদ্দিন সাহ্রির পর তাঁর মায়ের দুধ স্পর্শ করেননি, যা ইঙ্গিত দেয় যে রমজান শুরু হয়েছে।

বর্ণিত আছে যে, তাঁর জন্মের আগে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল যা তাঁর অলীত্ব প্রমাণ করে। শিশু ফরিদুদ্দিন (রহ.) গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন একদিন তাঁর মা বিনা অনুমতিতে তাঁর প্রতিবেশীর গাছ থেকে কিছু বরই নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর গর্ভে থাকা শিশুটি (হযরত বাবা ফরিদ) তাঁর পেটে প্রচণ্ড ব্যথা সৃষ্টি করেছিল, যা তাঁকে এ ধারণাটি ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। এ ঘটনার কয়েক বছর পর হযরত ফরিদুদ্দিন (রহ.) জন্মের সময় তাঁর মা স্নেহের সাথে বলছিলেন: “হে আমার প্রিয় পুত্র! তুমি গর্ভে থাকাকালীন আমি কখনই বেআইনি কিছু খাইনি।” হযরত বাবা ফরিদ (রহ.) অবশ্য হেসে বললেন, “হে আমার প্রিয় মা! তুমি আমাদের প্রতিবেশীর গাছ থেকে তার অনুমতি ছাড়াই কিছু বরই ছিঁড়তে চেয়েছিলে, কিন্তু তখন আমি তোমার পেটে প্রচণ্ড ব্যথার সৃষ্টি করেছিলাম, যা তোমাকে এই বেআইনি কাজ থেকে রক্ষা করেছিল।”

হযরত শেখ ফরিদুদ্দিন মাসউদ গঞ্জেশকর (রহ.) শৈশবেই পিতৃহারা হন। তাঁর জন্মের পর মাতা তাঁকে পাঞ্জাবের খাটোয়ালের মক্তবে মাওলানা সাইয়্যেদ নাজির আহমদ (রহ.)-এর কাছে দ্বিনি এলেমের প্রাথমিক শিক্ষা দিতে পাঠান। খাটোয়ালে ৭ বছর বয়সে প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা শেষ করার পর তাঁর মা তাকে উচ্চ শিক্ষার জন্য মুলতানে পাঠান। এখানে তিনি একটি মসজিদে অবস্থান করতেন, যেখানে তিনি পবিত্র কুরআন হিফজ করেন এবং হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। একদা হযরত খাজা কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.) যখন মুলতান শহরে গিয়েছিলেন, তখন তিনি শিশু হযরত শেখ ফরিদুদ্দিন (রহ.)-এর আধ্যাত্মিক প্রতিভা দেখে খুবই খুশি হয়েছিলেন। বালক ফরিদুদ্দিন মাসউদ গঞ্জেশকর (রহ.) ১১ বছর বয়সে পবিত্র কুরআন হিফজ করেন এবং মায়ের সঙ্গে হজ পালন করেন। বিভিন্ন ওস্তাদের নিকট ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করে খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.)-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং চিশতিয়া তরিকার খিলাফত ও ‘গঞ্জেশকর’ (শর্করা ভান্ডার) উপাধি লাভ করেন। হযরত শেখ ফরিদ্দুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) ছিলেন হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর সরাসরি বংশধর।

হযরত ফরিদ্দুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) তাঁর মোর্শেদের নির্দেশে এলেম অর্জনের জন্য ৫৯৩ হিজরি থেকে ৬১১ হিজরি (১১৯৬ থেকে ১২১৪ খ্রি.) প্রায় ১৮ বছর তিনি গজনি, বাগদাদ শরীফ, ইরান, জেরুজালেম, আফগানিস্তান, সিরিয়া-সহ বহু ইসলামি দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি মক্কা ও মদীনায় অনেক সুফি-সাধকদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
খেলাফত লাভ: হযরত শেখ ফরিদুদ্দিন মাসউদ গঞ্জেশকর (রহ.) মুলতানে একটি মসজিদের হুজরা শরীফে কঠোর ইবাদত বন্দেগি ও সাধনা রিয়াজতে মগ্ন থাকতেন। মাঝে মাঝে তিনি তাঁর মোর্শেদ খাজা বখতিয়ার উদ্দিন কাকি (রহ.)-এর দরবারে হাজির হতেন। একদা সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি (রহ.) দিল্লিতে আগমন করেন। তাঁকে কদমবুসি করার জন্য দিল্লির লোক দলে দলে তাঁর খেদমতে ভিড় করতে লাগলেন। সুলতান ইলতুতমিশও আসলেন, কিন্তু বাবা গঞ্জেশকর (রহ.) আসলেন না। তাঁকে না দেখে হযরত খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি (রহ.) তাঁর সম্বন্ধে খাজা বখতিয়ার কাকি (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন। তখন খাজা বখতিয়ার কাকি (রহ.) বললেন, সে চিল্লা করছে। এটা শুনে তিনি বললেন, তুমি সত্যই বখতিয়ার। এমন ‘শাহ্বাজ’ কবলে এনেছো, যে শাহ্বাজের বাস সিদরাতুল মুনতাহায়, এদিকে নয়। এমন লোকের উপর আর কঠোরতা করা সমীচীন নয়। চিল্লা করা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। অতঃপর তাঁরা উভয়ে ফরিদুদ্দিন মাসউদ গঞ্জেশকর (রহ.)-এর হুজরায় গেলেন এবং তাঁকে উভয়ের মাঝখানে রেখে দীর্ঘক্ষণ ধরে দোয়া করলেন। আল্লাহ্ পাক! ফরিদকে কবুল করুন। গায়েবি আওয়াজ আসলো, আমি ফরিদকে কবুল করলাম। অতঃপর তাঁরা উভয়ে তাঁকে প্রচুর পরিমাণে রুহানি ফায়েজ দান করলেন এবং বললেন, ফরিদ এমন একটি প্রদীপ, যা আমাদের সিলসিলাকে উজ্জ্বল করবে এবং যুগের অদ্বিতীয় হবে।

হযরত সুলতানুল হিন্দ (রহ.)-ও তাঁকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতেন। এই বরকতেই আজ পর্যন্ত তাঁকে ‘বাবা’ উপাধিতে স্মরণ করা হয়। উভয়ে বাবা সাহেবকে ফায়েজ প্রদানের পর হযরত খাজা বখতিয়ার কাকি (রহ.) গঞ্জেশকর (রহ.)-কে বললেন, দাদা পিরকে (খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি) কদমবুসি করো। কিন্তু ফরিদুদ্দিন মাসউদ গঞ্জেশকর (রহ.) খাজা বখতিয়ার কাকি (রহ.)-কে কদমবুসি করলেন। খাজা বখতিয়ার কাকি (রহ.) বললেন, আমি তোমাকে বললাম, দাদা পিরের কদমবুসি করো। আর তুমি আমাকে কদমবুসি করলে। বাবা সাহেব উত্তর করলেন, ঐ কদম ব্যতীত আর কোনো কদমই আমি দেখতে পাই না। এ জবাব শুনে খাজা আজমিরি (রহ.) বললেন, বখতিয়ার! মাসউদ ঠিকই বলছে। সে মঞ্জিলের দরজায় পৌঁছে গিয়েছে, সেখানে এক ভিন্ন দ্বিতীয়ের অস্তিত্বই নেই। কাজেই তথায় তুমি ভিন্ন আমি তাঁর দৃষ্টিপথে আসব কেন?

বর্ণিত আছে যে, হযরত ফরিদ্দুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) যখন মদীনা শরীফ জিয়ারত করেন, তখন তিনি আধ্যাত্মিকভাবে মহানবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশ লাভ করেন। পরে তিনি বাগদাদ শরীফ জিয়ারতে গেলে গাউসে পাক হযরত আবদুল কাদির জিলানি (রহ.)-এর পুত্র হযরত আবদুল ওয়াহাব (রহ.)-এর সঙ্গে দেখা করেন। কারণ গাউসে পাক আবদুল কাদির জিলানি (রহ.)-এর কাছ থেকে কিছু পবিত্র নিদর্শন পাওয়ার কথা ছিল। তদনুসারে তিনি বাগদাদ শরীফে পৌঁছে হযরত আবদুল ওয়াহাব (রহ.)-এর কাছ থেকে একটি বাক্স গ্রহণ করেন। যার মধ্যে ছিল দুটি পতাকার খুঁটি, যা মহানবি (সা.) যুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন; একটি কাঠের বাটি, যাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) খাবার খেতেন; এক জোড়া কাঁচি মোবারক এবং একটি পাগড়ি মোবারক, যা মহানবি (সা.) ব্যবহার করতেন।

হযরত শেখ ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) সমকালীন বিখ্যাত সুফি হযরত শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী (রহ.), হযরত খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি (রহ.), হযরত বাহাউদ্দিন জাকারিয়া (রহ.) এবং হযরত জালালুদ্দিন তাবরিজি (রহ.)-এর সান্নিধ্য লাভ করেন। হযরত ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)-এর ‘ফাওয়ায়েদুস সালেকিন’, হযরত বদরুদ্দিন ইসহাক (রহ.)-এর ‘ইসরারুল আউলিয়া’, হযরত আমির হাসান সিজ্জির ‘ফাওয়ায়ে দুলফওয়াদ’ এবং হযরত আমির খসরু (রহ.)-এর ‘আফজালুল ফাওয়ায়েদ’ গ্রন্থে তাঁর জীবন ও কর্মসম্পর্কে নানা তথ্য আছে। তিনি বহুলোককে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। তাঁর দরবার শরীফ সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। বাবা ফরিদ (রহ.)-এর খানকাহ শরীফটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল। হাজার হাজার সুফি এই আধ্যাত্মিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপকৃত হয়েছেন। হযরত বাবা ফরিদ (রহ.) নফসের উপর আধিপত্য অর্জনের জন্য অত্যন্ত কঠোর মুজাহিদের (আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা) মাধ্যমে আধ্যাত্মিক গৌরবের শিখরে পৌঁছেছেন।
হযরত শেখ ফরিদুদ্দিন মাসউদ (রহ.)-এর প্রধান খলিফাদের মধ্যে ছিলেন তাঁর জামাতা হযরত বদরুদ্দিন ইসহাক (রহ.), হযরত খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.), হযরত জালালুদ্দিন হাসুবি (রহ.), হযরত আলী আহমদ সাবির (রহ.), হযরত শেখ আরিফ (রহ.) প্রমুখ। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকা জনপ্রিয়তা লাভ করে।

কারও কারও মতে হযরত শেখ ফরিদুদ্দিন (রহ.) চট্টগ্রামের ষোলশহরের একটি টিলায় ৩০ বছর অধ্যাত্ম সাধনা করেন। তাঁর চোখের পানিতে একটি ফোয়ারার সৃষ্টি হয় বলে প্রবাদ আছে, যা ‘শেখ ফরিদের চশমা’ নামে অভিহিত। সেখানে তাঁর মাজার শরীফ অবস্থিত। প্রতি বছর ৫ই মহররম তাঁর ওরস পালিত হয়। [দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, বাংলা পিডিয়া] কথিত আছে, তিনি যে স্থানে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্র সাধনায় মগ্ন ছিলেন সেই স্থানে আল্লাহ্র ইচ্ছায় ঝর্ণার সৃষ্টি হয়। সেই ঝর্ণা থেকে এখনো পর্যন্ত অনবরত পানি নির্গত হচ্ছে। এই ঝর্ণাটির নাম দেওয়া হয়েছে শেখ ফরিদের চশমা। শত শত বছর ধরে এই ঝর্ণার পানি জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে অতি পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই ঝর্ণার পানি নেওয়ার জন্য এখানে প্রতিদিন শত শত নারী-পুরুষ আসেন। চট্টগ্রামের অতীত ইতিহাসের সমৃদ্ধ সম্পন্ন এই স্থানটিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন দর্শনীয় স্থানের রূপ দিয়েছেন। দিল্লির সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদের রাজত্বকালেই তাঁর আবির্ভাব হয়। সুলতান নাসির উদ্দিন ১২৪৬ খ্রি. থেকে ১২৬৫ খ্রি. পর্যন্ত দিল্লির সিংহাসন রাজত্ব করেন। তিনি একজন ধর্মভীরু অমায়িক এবং ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। তিনি সুলতান হয়েও দরবেশদের মতো জীবন-যাপন করতেন এবং অবসর সময়ে পবিত্র কুরআন নকল করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দিল্লির এই সুলতান হযরত শেখ ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ,)-কে খুব শ্রদ্ধা এবং ভক্তি করতেন। তাঁর উপদেশ মতো রাজকার্য পরিচালনা করতেন। এমনকি দেশ জয়ের ব্যাপারেও তাঁর কাছে দয়া প্রার্থনা করতেন। হযরত শেখ ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) পরবর্তীতে দিল্লির সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবানের কন্যাকে বিবাহ করেন।

গঞ্জেশকর উপাধি: বর্ণিত আছে যে, একবার এক ব্যবসায়ী চিনি বোঝাই উটের কাফেলা নিয়ে মুলতান থেকে দিল্লি যাচ্ছিলেন। তিনি যখন অজোধন (বর্তমান পাকিস্তান) দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন হযরত বাবা ফরিদুদ্দীন (রহ.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, উটের পিঠে বস্তায় কী আছে? ব্যবসায়ীটি ব্যঙ্গ করে উত্তর দিলো, “এটা লবণ।” ব্যবসায়ী যখন দিল্লিতে পৌঁছলেন, তখন তিনি দেখেন যে, তার সমস্ত চিনির বস্তাগুলো লবণে পরিণত হয়েছে। তিনি অবিলম্বে অযোধনে ফিরে আসেন এবং হযরত বাবা ফরিদ (রহ.)-এর কাছে মিথ্যা বলার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পরে ব্যবসায়ী দিল্লিতে ফিরে আসেন এবং দেখে খুশি হন যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র রহমতে লবণ আবার চিনিতে পরিণত হয়েছে। এভাবেই হযরত বাবা সাহেব (রহ.) ‘গঞ্জেশকর’ উপাধি পান।

অন্য বর্ণনায় দেখা যায়, শৈশবে তাঁর মাতা তাঁকে নামাজের পাবন্দ করার জন্য প্রত্যেক নামাজের সময় মুসল্লার নিচে চিনির একটি পুরিয়া রেখে দিতেন এবং বাবা ফরিদকে বলতেন, যে সমস্ত শিশু নামাজ পড়ে তারা প্রত্যহ নামাজের মুসল্লার নিচে আল্লাহ্ পাকের তরফ হতে চিনি পেয়ে থাকে। একদিন তাঁর মাতা মুসল্লার নিচে রাখতে ভুলে গেলেন। নামাজের সময় পার হয়ে গলে মাতা চিন্তিত মনে পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, মাসউদ! তুমি নামাজ পড়েছ কি না? তিনি উত্তর দিলেন: হাঁ। মা! নামাজও পড়েছি, চিনির পুরিয়াও পেয়েছি। এই উত্তর শুনে মা খুব আশ্চর্যান্বিত হলেন এবং বুঝতে পারলেন, এই শিশুর প্রতি গায়েবি মদদ হয়ে থাকে। তখন হতে তিনি পুত্রকে ‘গঞ্জেশকর’ বলতে লাগলেন। আজ পর্যন্ত লোকমুখে সেই উপাধি মশহুর হয়ে আছে।

ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)-এর আওলাদ: হযরত ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)-এর পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা ছিল। পুত্রগণের নাম যথাক্রমে শেখ নাসিরুদ্দিন, নাসরুল্লাহ্, শেখ বদরুদ্দিন সুলায়মান, শেখ শেহাবুদ্দিন, খাজা নিজামুদ্দিন ও শেখ ইয়াকুব। কন্যাদের নাম বিবি মাস্তুরা, বিবি শরীফা ও বিবি ফাতেমা।

গঞ্জেশকর (রহ.)-এর তিনটি সিলসিলা: হযরত গঞ্জেশকর (রহ.) হতে চিশতিয়া সিলসিলার তিনটি শাখা বের হয়। যথা- নিজামিয়া, সাবেরিয়া ও জামালিয়া। জামালিয়া সিলসিলা পরিশেষে নিজামিয়া সিলসিলার মধ্যে মিশে গেছে।

ওফাত: হযরত শেখ ফরিদুদ্দিন মাসউদ গঞ্জেশকর (রহ.) ৬৬৬ হিজরি ১২৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের পাকপাত্তানে ওফাত লাভ করেন।

মাজার শরীফ: ওফাতের সময় হযরত শেখ ফরিদুদ্দিন মাসউদ গঞ্জেশকর (রহ.) অছিয়ত করেন, আমার খেরকা, লাঠি, খড়ম ও অন্যান্য বস্তুগুলি খাজা নিজামুদ্দিন আওলিয়া (রহ.) পাবে। আমার মাজারও সে নির্মাণ করবে। তাঁর ওফাতের পর তাঁর দেহ মোবারক আমানতস্বরূপ দাফন করা হলে হযরত নিজামুদ্দিন আওলিয়া (রহ.) পাকপাত্তানে আসলে হযরত ফরিদুদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)-এর অছিয়তকৃত বস্তুগুলি তাঁকে দেওয়া হয়। তিনি হযরত বাবা সাহেবের লাশ মোবারক পুনরায় বর্তমানে যেখানে মাজার শরীফ অবস্থিত, সেখানে এনে দাফন করলেন এবং মাজারের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে দুটি দরজা রাখলেন। দক্ষিণ দিকের দরজাটিকে ‘বেহেশতি দরজা’ এবং পূর্ব দিকের দরজাটিকে ‘নুরি দরজা’ বলা হয়।

কথিত আছে যে, হযরত নিজামুদ্দিন আওলিয়া (রহ.) মাজারের নির্মাণ কার্য সমাপ্ত হওয়ার পর একদিন মাজারের দক্ষিণ দিকের দরজায় দণ্ডায়মান ছিলেন, এমন সময়ে ভাবাবেগে তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, নবি করিম (সা.) তশরিফ এনে বলছেন, “এই দরজা দিয়ে যে ব্যক্তি প্রবেশ করবে সে বেহেশতি হবে।” এ ঘটনার পর হতে জেয়ারতকারীদের জন্য শুধু পূর্ব দিকের দরজাটি খোলা রাখা হয়। দক্ষিণ দিকের দরজা- যাকে বেহেশতি দরজা নাম দেওয়া হয়েছে, এটা কেবল ওরসের সময় অর্থাৎ ৫ই মহররম সন্ধ্যা সময় খুলে দেওয়া হয়। অন্যান্য সময় বন্ধ থাকে। যারা বর্তমানে এখনও তাঁর মাজার শরীফের দেখাশোনা করছেন তারা ‘দিওয়ান’ নামেই বেশি পরিচিত। শিখধর্মে তাঁর স্থান তাঁর শ্লোকগুলি গুরু নানক ফরিদের বাণী অধ্যায়ের অধীনে ‘গুরু গ্রন্থ সাহেবে’ সংগৃহীত হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১। তায্কেরাতুল আওলিয়া, চতুর্থ খণ্ড, মাওলানা নূরুর রহমান, এমদাদিয়া পুস্তকালয় প্রা. লি. ৫০ বাংলাবাজার, ঢাকা
২। https://bn.banglapedia.org/index.php?title

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *