দেওয়ানবাগ ডেস্ক: বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো হৃদরোগের চিকিৎসায় সর্বাধুনিক ‘রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি’ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। তারা রোবট দিয়ে সফলভাবে দুই জন হৃদরোগীর হার্টে রিং পরিয়েছেন। এর মাধ্যমে চিকিৎসায় রোবোটিক প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। বর্তমানে রোগীরা ভালো আছেন।
গত রবিবার এ দুই হৃদরোগীর প্রধান ধমনিতে বিনা মূল্যে রোবটের মাধ্যমে রিং পরানো হয়। রোবোটিক সার্জারির এই অস্ত্রোপচার করেন হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার ও তার বিশেষায়িত টিম। এই চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্বোধন করেন হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল হাসান মিলন ও কার্ডিলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. সালাউদ্দিন।
গতকাল জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল হাসান মিলন বলেন, ‘রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি ট্রায়াল হিসেবে দুই জন রোগীর হার্টে রিং পরানো হয়েছে। হাতে রিং পরালে কিছুটা সমস্যা হতে পারে, কিন্তু রোবটের মাধ্যমে রিং সূক্ষ্মভাবে পরানো যায়। ট্রায়াল হিসেবে দুই জনকে দেওয়া হয়েছে। ফ্রান্সের তৈরি ৫ কোটি টাকার এই রোবট এক মাস থাকবে বাংলাদেশে। রোবট কোম্পানি রোবটের সঙ্গে ১০টি ডিভাইস দিয়েছে। এসব ডিভাইস দিয়ে ১০ জন রোগীকে আমরা বিনা মূল্যে রোবটের মাধ্যমে রিং পরাতে পারব। পুরোপুরি সফল হলে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকারকে অনুরোধ জানাবে রোবট কিনে দেওয়ার জন্য।’
ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার গণমাধ্যমকে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন। তিনি বলেন, ওয়ারলেসের মাধ্যমে সার্জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ, রোগী ছিলেন ভেতরে, ডাক্তাররা ছিলেন বাইরে কন্ট্রোলরুমে। তিনি বলেন, রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি বর্তমান পৃথিবীতে হার্টের রিং পরানোর সর্বাধুনিক এবং সর্বশেষ প্রযুক্তি। কার্ডিওলজিস্টরা এখনো ক্যাথল্যাবে নিজেরা রোগীর কাছ থেকে রোগীদের হার্টের রিং পরান। কিন্তু রোবটের মাধ্যমে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা রোগীর চেয়ে দূরে থেকে নিখুঁতভাবে হৃদরোগীদের হার্টের ধমনিতে রিং পরান। এই রোবটের দুটি অংশ থাকে—একটি হলো রোবটের একটি হাত, যা ক্যাথল্যাবে থাকে। আরেকটি থাকে কন্ট্রোল সেকশনে, যেখান থেকে মূল কার্ডিওলজিস্ট পুরো রিং পরানো কার্যক্রম দূর থেকে সম্পন্ন করে থাকেন।
কী সুবিধা এই সার্জারিতে :অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার বলেন, রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টির প্রথম সুবিধা হলো, হার্টের রিং পরানোর জটিল প্রক্রিয়াটি রোবটের মাধ্যমে খুব সূক্ষ্ম ও নিখুঁতভাবে করা যায়। রোগীদের জন্য আরেকটি সুবিধা হলো, হৃদরোগ চিকিতসকদের সরাসরি এনজিওপ্লাস্টি করতে গেলে যে সময় লাগে, রোবটের মাধ্যমে সেটি করতে অনেক কম সময় লাগে এবং জটিলতাও কম হয়। যেসব চিকিৎসক অনেক এনজিওপ্লাস্টি করেন, একসময় তারা দুটি সমস্যায় পড়েন। প্রথমত, রেডিয়েশনের কারণে অনেক চিকিৎসক ব্রেন ক্যানসার ও চোখে ক্যাটারাক্টসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার ঝুঁকিতে পড়েন। এছাড়া হৃদরোগ চিকিৎসকেরা যখন অপারেশন থিয়েটার বা ক্যাথলেবে কাজ করেন, রেডিয়েশন প্রটেকশনের জন্য তাদের ১২ থেকে ১৫ পাউন্ড ওজনের একটি বিশেষ জামা দীর্ঘক্ষণ যাবত পরতে হয়। ফলে ঘাড়ের নার্ভের ওপর চাপ পড়ে এবং পরে চিকিৎসক খুব বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘাড় ও হাতে ব্যথার কারণে এনজিওপ্লাস্টি করতে পারেন না। রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে রেডিয়েশন ছাড়াই এবং ভারী বিশেষ জামা পরা ছাড়াই ক্যাথল্যাবে কন্ট্রোলরুমে, তার অফিসে, সুযোগ-সুবিধা থাকলে বাসায় বসে অথবা দেশের বাইরে থেকেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে হার্টের রিং পরাতে পারবেন। দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, অত্যাধুনিক এই চিকিৎসা প্রযুক্তি চালু হলে রোগীকে আর দেশের বাইরে যেতে হবে না বলেও জানান ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার।
এখন দরকার দক্ষ জনবল: জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার ভারতের হায়দ্রাবাদের অ্যাপোলো হসপিটাল এবং চীনের সাংহাই থেকে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টের ওপরে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাছাড়া তিনি রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টিতে ভারতের প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. পিসি রাথের কাছ থেকে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এখন আরও বেশি দক্ষ জনবল দরকার।
মেশিনের দাম ৫ কোটি টাকা :যে রোবট দিয়ে এনজিওপ্লাস্টি করা হয়েছে, সেটি ফ্রান্সের তৈরি এবং দাম ৫ কোটি টাকা বলে জানান ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার। তিনি বলেন, রোবটটি এক মাস ব্যবহারের জন্য ফ্রান্স থেকে আনা হয়েছে। সঙ্গে সেই দেশের টেকনোলিজস্টগণ রয়েছেন। যদি রোবোটিক সিস্টেমটি বাংলাদেশের অবকাঠামোর সাথে সহায়ক হয়, তাহলে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল এই রোবোটিক সিস্টেম কেনার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করবে এবং খুব কম খরচে আন্তর্জাতিক সর্বাধুনিক এই প্রযুক্তি সব সময়ের জন্য জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চালু রাখতে পারবে। এভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ডিজিটালাইজ পদ্ধতি ব্যবহার করার সুযোগ পাবে।
বিশ্বে আগেই শুরু: চিকিৎসকেরা আরও জানান, রোবটের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহু আগেই শুরু হয়েছে। স্পাইনাল সার্জারিতে এটা ইতিমধ্যে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত। রোবোটিক করোনারি আটারি বাইপাস গ্রাফ্ট বা সিএবিজি ভারত ও সিংগাপুরে হচ্ছে। ভারতে ১৯১৮ সালে অধ্যাপক ডা. তেজেশ প্যাটেল এটা প্রথম শুরু করেন। তিনি যখন প্রথম রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি করেন, তখন তিনি তার থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে এক রোগীর হার্টের রিং পরান। তখন থেকে এটি সারা বিশ্বে শুরু হয় এবং এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলছে, প্রতিনিয়ত গবেষণা এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি এর সাথে সংযুক্ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিশ্বে ১৬০টি দেশে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি সেন্টার রয়েছে।