চট্টগ্রাম সংবাদদাতা: বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হলেও সাগরের সম্পদ আহরণে উদ্যোগ এখনো অপ্রতুল। সমুদ্রে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব, প্রযুক্তিস্বল্পতা, দক্ষ লোকবলের অভাব প্রভৃতি কারণে সম্পদ আহরণ সীমিত হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি, সাগরকে ব্যবহার করে লাভবান হওয়ার সুযোগও তেমন কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বঙ্গোপসাগর থেকে অর্থনৈতিক উন্নতির সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগও অপ্রতুল।
বঙ্গোপসাগরের তলদেশে বিপুল পরিমাণ তেল-গ্যাস মজুত আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বিদেশি একটি কোম্পানির মাধ্যমে সিসমিক সার্ভে করানো হয়। সার্ভের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় ১৭-১০৩ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট) গ্যাস হাইড্রেট তথা মিথেন গ্যাসের মজুত রয়েছে। তাছাড়া, বঙ্গোপসাগরের যে অংশে ভারত ও মিয়ানমার গ্যাস উত্তোলন করছে; বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে ওই অঞ্চলে গ্যাস পাওয়া স্বাভাবিক বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বাংলাদেশের জলসীমায় তেল-গ্যাসের মজুত সম্পর্কে ধারণার অভাবে বিদেশি কোম্পানিগুলোর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে কম আগ্রহ দেখা গেছে। দু-একটি কোম্পানি আগ্রহ দেখালেও তারা তাদের উৎপাদিত তেল ও গ্যাস পুরোটা রপ্তানির অনুমতি চায়। তেল-গ্যাস রপ্তানির অনুমতি না দিলে রপ্তানি দরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশকে তাদের উৎপাদিত তেল ও গ্যাস ক্রয়ে বাধ্যতামূলক চুক্তির শর্তও দিচ্ছে। সম্প্রতি মার্কিন কোম্পানি এক্সন মবিল বাংলাদেশে বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এছাড়াও, বাণিজ্য, নৌপরিবহণ, মৎস্য আহরণ, সমুদ্রের তলদেশের মূল্যবান খনিজ সম্পদের আহরণের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি খুব সামান্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি কোস্টগার্ডের জাহাজ তাজউদ্দীনের মাধ্যমে কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন ডিকাবের সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা পরিদর্শন আয়োজন করে। চট্টগ্রামের কোস্টগার্ড জেটি থেকে শুরু হয়ে কাফকো, কর্ণফুলী টানেল, নেভাল একাডেমি, বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স, রেডকিন পয়েন্ট, বহির্নোঙর, সাঙ্গু নদীর মোহনা, এস আলম পাওয়ার প্ল্যান্ট, কুতুবদিয়া নোঙর এলাকা, মাতারবাড়ী বন্দর, সিঙ্গেল মুরিং পয়েন্ট, ড্রাইডক, গুপ্তা বেন্ড, মেরিন একাডেমির আশপাশে জাহাজ প্রদক্ষিণ করে।
এ সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) খোরশেদ আলম জাহাজে ছিলেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমাদের সমুদ্রসীমা একটা বিশাল এলাকা। তবে এটাও ঠিক যে, আমাদের যে ধরনের টেকনোলজি দরকার; সেই টেকনোলজি আমাদের কাছে নেই। বিশেষ করে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে আমরা একটা সিসমিক সার্ভে করিয়েছি। সার্ভেই বলে দেবে কোন জায়গায় তেল-গ্যাস আছে। এই সার্ভের প্রেক্ষিতে বিদেশি কোম্পানিগুলো আসবে। বিশ্বের তেল-গ্যাসের প্রায় ৩৪ ভাগ সাগরের নিচ থেকে আসে। তবে বঙ্গোপসাগরে কী পরিমাণ তেল-গ্যাস আছে সেটা তিনি জানাতে অস্বীকার করেন।
অন্ধ্র উপকূল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাসের বড় মজুত আবিষ্কার করেছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ওএনজিসি। খনিটির তৃতীয় ফেজের কাজ চলমান রয়েছে। এটি শেষ হলে এখান থেকে দিনে ৪৫ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল এবং ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর ১৪ বছর পেরিয়েছে। ভারতের সঙ্গে এ সীমার নিষ্পত্তি হয়েছে ১০ বছর আগে। দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলনে কোনো সাফল্যের দেখা পায়নি বাংলাদেশ। দেশের বিশাল সমুদ্র এলাকার জ্বালানি সম্ভার এখনো অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হয় মিয়ানমারের। এরপর ২০১৩ সালে এখান থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে দেশটি। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ঘেঁষে অবস্থিত মিয়া ও শোয়ে কূপ থেকে এরই মধ্যে কয়েক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করেছে দেশটি।
বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ বিভিন্ন গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করা হয়। এসব গ্যাস বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাপেক্স, গ্যাস ফিল্ড লিমিটেড, সিলেট ফিল্ড লিমিটেড এবং যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন উত্তোলন করে। শেভরন জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে চাহিদার ৪০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করে। বাকি ২০ ভাগ উত্তোলন করে দেশিয় তিন কোম্পানি। এই ৬০ ভাগের বাইরে চাহিদার ৪০ শতাংশ তরল গ্যাস তথা এলএনজি আকারে তিনটি কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের এক্সেলারেট এনার্জি, সিঙ্গাপুরের সামিট গ্রুপ এবং অন্য একটি কোম্পানি আমদানি করে। জাহাজের মাধ্যমে তরল গ্যাস আমদানির পর বঙ্গোপসাগরে ‘ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট’র (এফএসআরইউ) মাধ্যমে গ্যাসে রূপান্তর করে পাইপলাইনে চট্টগ্রামে গ্রিডে যুক্ত করা হয়। সম্প্রতি এফএসআরইউতে সমস্যা দেখা দিলে গ্যাস সংকটের সৃষ্টি হয়। তবে বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। সম্প্রতি মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে। তার পাশে ভারতও উত্তোলন করছে। উভয় স্থানের মাঝে বাংলাদেশের জলসীমায় অনুসন্ধান শুরুই হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন সরকার সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে বিদেশি কোম্পানি নিযুক্তির কাজ শুরু করলে এক বছরের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন সম্ভব।
জাহাজস্বল্পতা : তেল-গ্যাস ছাড়াও সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচল রয়েছে। জাহাজ চলাচলে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব অধিক। বঙ্গোপসাগর দিয়ে প্রতিদিন ১৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল চলাচল করে। বিদেশে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আছে প্রায় ১৪০ বিলিয়ন ডলার। পুরোটাই সাগর দিয়ে হয়ে থাকে। প্রতিবছর পাঁচ হাজার জাহাজ মালামাল নিয়ে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করে। এসব জাহাজকে ভাড়া বাবদ বছরে নয় বিলিয়ন ডলার গুনতে হয়। বাংলাদেশের জাহাজ আছে মাত্র ১০২টি। বাকিগুলো বিদেশি জাহাজ। বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলো গভীর নয়। মোংলা বন্দর সমুদ্র থেকে ১৩০ কিলোমিটার ভেতরে নদীর মধ্যে। পায়রাবন্দর সমুদ্র থেকে নদীর মাধ্যমে ৭৫ কিলোমিটার ভেতরে এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্ণফুলী নদীর মাধ্যমে ১৫ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত। এসব বন্দরে ৯ মিটার গভীর পানিতে চলাচলের উপযুক্ত জাহাজ আসতে পারে। মাতারবাড়ীতে জাপানি আর্থিক সহায়তায় গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে। মাতারবাড়ীতে বর্তমানে ১৪ মিটার গভীরতা পর্যন্ত জাহাজ চলাচল করতে পারে। ২০২৬ সালে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর পুরোপুরি চালু হলে তার গভীরতা ১৮ মিটারে দাঁড়াবে।
জাহাজ চলাচল খাত থেকে নাবিক পদে যোগদান করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। জাহাজে একজন ক্যাপ্টেনের বেতন মাসে ১০ হাজার ডলার। বিশ্বে জাহাজের ক্যাপ্টেন আছেন ২৫ লাখ। বাংলাদেশের ক্যাপ্টেন কয়েক হাজার মাত্র। ছয়টি মেরিন একাডেমি চালু হয়েছে। এখান থেকে বছরে তিন থেকে চারশ ক্যাপ্টেন বের হবেন। তবে বাংলাদেশের জাহাজের সংখ্যা কম থাকায় এক বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি।