দেওয়ানবাগ ডেস্ক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী রায়হান শফি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়ার পরই বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ পেয়েছেন। সর্বশেষ একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির দেশীয় ব্রাঞ্চে ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। তার বেতন দেড় লাখ টাকার ওপর। এর সঙ্গে কোম্পানির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও ছিল। কিন্তু তারপরও দেশে থিতু হননি। স্ত্রী ও সন্তানসহ কানাডা ভিসার জন্য আবেদন করেন। কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি একটি গাড়ির শোরুমে এখন তিনি কাজ করছেন। ভবিষ্যতে পরিবার নিয়ে কানাডাতেই স্থায়ী হওয়ার ইচ্ছা তার। খুব শিগগিরই তার স্ত্রী ও সন্তান কানাডা পাড়ি জমাবেন।
মুঠোফোনে ‘বাংলাদেশে এত ভালো চাকরি ও জীবনযাপন করার পরও কেন দেশের বাইরে চলে গেলেন’ এমন প্রশ্নে রায়হান শফি বলেন, ‘পরিবার নিয়ে যে লাইফস্টাইল চাই তা বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশে পেরে উঠব না। এ ছাড়া সন্তানের ভবিষ্যতের বিষয়টিও আছে।’
৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শ্রম পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পরও হাসান জাভেদ (ছদ্মনাম) নামের আরেক তরুণ এখন বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন। তিনি বলেন, ‘আমি কানাডায় যাওয়ার চেষ্টা করছি। কাগজপত্রও জমা দেওয়া শেষ।’ অথচ ২০১৮ সালে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার পর এতগুলো বছর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরি করার কথাই ভেবেছিলেন এই যুবক। এখন কেন সেই চিন্তা থেকে সরে আসছেন- এমন প্রশ্নে হাসান জাভেদ বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা চিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছি। এ ছাড়া বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাতে হলে মাস শেষে যা বেতন পাব তা দিয়ে জীবন চালানো কঠিন।’
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থায় প্রভাবশালী পদে কর্মরত ছিলেন নারী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার। ভালো বেতন ও গাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পরও সম্প্রতি চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে নিজের স্বামী ও কন্যাকে নিয়ে কানাডায় পাড়ি জমান জেসমিন। সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করে পরবর্তীতে সেখানেই থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা তার। রায়হানের মতো এই সরকারি কর্মকর্তাও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময়ই স্বামীসহ বিদেশে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল।’ নিজেদের তো বটেই, সন্তানের ভবিষ্যৎও জেসমিনের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। দেশের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেকার শিক্ষিত যুবকরা তো বটেই ‘সোনার হরিণ’ বা স্বপ্নের চাকরি পাওয়ার পরও সেই চাকরি ছেড়ে বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। জীবিকা অর্জনের আশায় বেকার যুবকরাই শুধু দেশ ছাড়ছেন এমন ধারণা প্রচলিত থাকলেও এখন দেখা যাচ্ছে ভালো উপার্জন ও চাকরি থাকা সত্ত্বেও তরুণ প্রজন্ম দেশ ছাড়ছে। তারা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিজেদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং তাদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মেধা পাচারের সঙ্গে এখন সক্ষমতাও পাচার হচ্ছে। তারা আরও বলেন, স্বাবলম্বী তরুণদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্যই সমস্যার। শ্রীলঙ্কা, ভারতের কোনো কোনো রাজ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং নেপালেও এ সমস্যা আছে। এটি এক ধরনের আঞ্চলিক সমস্যা। দেশের তরুণরা কর্মক্ষেত্রে কাজ করে আনন্দ, সন্তুষ্টি পান না। এ জন্য বিদেশে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে তারা চলে যেতে চান। তরুণদের মেধার বিকাশও দেশে সেভাবে হচ্ছে না। দেশের আইটি খাত নিয়ে দক্ষ তরুণদের অনেকেই আছেন যাদের এ দেশে নিজেদের সক্ষমতা দেখানোর সুযোগ পর্যন্ত নেই। এজন্য এদের অনেকে বিদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ পেলে চলে যান। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে এখন একজন বিদেশে গিয়ে ভালো কিছু করলে অন্যরাও বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত হন। দেশের অনেক তরুণ আছেন যারা ভাড়া বাড়িতে থাকেন এবং নিজেদের ফ্ল্যাট বাড়ি কেনার সক্ষমতা নেই, কিন্তু বিদেশে গিয়ে সেই তরুণই এক বছরের মধ্যে বাড়ি কেনার সুযোগ পান। মোটকথা যে স্বপ্নগুলো এ দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত তরুণরা দেখেন তা আমরা বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিই না।
২০২২ সালে প্রকাশিত ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, অন্তত ৪৯ হাজার ১৫১ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ৫৮টি দেশে পড়াশোনার জন্য গেছেন। আর উচ্চশিক্ষার জন্য গেলেও এদের অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত বিদেশে থেকে যান। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম তরুণদের নিয়ে এক জরিপ প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ভালো জীবনযাপন ও পেশার উন্নতির জন্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৮২ শতাংশ তরুণ নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। এক্ষেত্রে তাদের পছন্দের দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া। এসব তরুণের বেশির ভাগই দেশের বাইরে ভবিষ্যৎ গড়ার ইঙ্গিত দেন। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এ দেশ যারা পরিচালনা করে তারা যখন মেধার মূল্য দিতে পারে না এবং অমেধাবীদের মূল্যায়ন করা হয়, তখন মেধাবী তরুণরা বিদেশমুখী হয়ে পড়েন। রাজনীতি ও বিত্তের প্রভাবে অনেক পরিবারের সন্তান যোগ্যতা না থাকলেও অনেকে ওপরে উঠে যায়। জেলা পর্যায়ে অনেক সরকারি চাকরিতেও এখন ঘুষ দিতে হয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলেও অনেক সময় রাজনীতির দ্বারস্থ হতে হয়। আর একজন শিক্ষার্থী যখন ঘুষ ও দুর্নীতির পাল্লায় পড়ে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই বিদেশমুখী হয়ে যায়। এ ধারা রোধ করতে সরকারের সব কর্মকান্ড সাধারণ মানুষের সামনে উন্মুক্ত করতে হবে। এ ছাড়াও ক্ষমতার জোরে কেউ যেন কিছু দখল করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তরুণদের জন্য সুন্দর জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার পর তরুণদের জন্য স্বল্পমূল্যে দীর্ঘকালীন কিস্তির মাধ্যমে ফ্ল্যাট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। স্বজনপ্রীতি হলে তার তদন্ত করতে হবে।