প্রফেসর ড. এম এম আকাশ: বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এটি হঠাৎ করে হয়নি। মূলত করোনা-পরবর্তী সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে শুরু করে। করোনকালীন অবস্থায় আমাদের রপ্তানি আয় ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল। একইসঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের বাইরে থেকে যে রেমিট্যান্স প্রেরণ করতেন, তার পরিমাণও কমে যায়। রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিলেও আমরা আমদানি ব্যয় কমাতে পারিনি। তবে করোনাকালেও আমাদের কৃষিখাত মোটামুটি ভালো পারফর্ম করেছিল। যে কারণে বাংলাদেশকে খাদ্যপণ্য নিয়ে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি বা দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে হয়নি। আর সরকার উদার ব্যাংকনীতি অনুসরণ করায় স্থানীয়ভাবে টাকা-পয়সার কোনো সমস্যা হয়নি। ফলে স্থানীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। সামগ্রিক বিবেচনায় স্থানীয় গ্রোথ রেট চাঙা ছিল। অর্থাৎ করোনার কারণে অন্যান্য দেশের অর্থনীতি যেভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। কিন্তু সেসময় আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বিপর্যয়কর অবস্থার প্রভাব আমাদের দেশের অর্থনীতিতেও পড়ে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে পড়ে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্য, বিশেষ করে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। জ্বালানি তেলের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমাদের আমদানি খরচ বেড়ে যায়।
আগে থেকেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অভাব ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের আমদানির জন্য বাড়তি ডলারের প্রয়োজন দেখা দেয়। আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে এবং আমরা মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন শুরু করলাম। ডলারের অবমূল্যায়ন শুরু করায় মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যায়, যেহেতু সব ধরনের আমদানি পণ্যের মূল্য বেড়ে যায়। এ একাধিক সংকটের যুগপৎ সম্মিলনের কারণে আমাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্টস সারপ¬াসটা কমে গেল। কারেন্ট অ্যাকাউন্টসটার হিসাব পদ্ধতিটি এরকম- ‘রপ্তানি আয় প্ল¬াস রেমিট্যান্স আয় মাইনাস আমদানি ব্যয়’। আমাদের দেশের আমদানি ব্যয় রপ্তানি আয়ের তুলনায় বেশি। তার সঙ্গে যখন ইতিবাচক রেমিট্যান্স যোগ করা হয়, তখন ফিগারটি পজিটিভ হয়। যতদিন পর্যন্ত রেমিট্যান্স নিট ব্যালেন্স অব ট্রেডের চেয়ে বেশি হয়, ততদিন আমাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্টস উদ্বৃত্ত থাকে। এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বাড়তে থাকে। যে সংকটগুলোর কথা বললাম, সব সংকট একত্রে সন্নিবেশিত হওয়ার কারণে আমাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্টস সারপ্লাসটা আর থাকছে না। আমাদের রপ্তানি আয় দ্বারা সব আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছি না। রেমিট্যান্স দিয়ে আমদানি ব্যয়ের অবশিষ্ট অংশ মেটানোর পর কিছু অর্থ উদ্বৃত্ত থাকত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, চলতি রপ্তানি আয় ও চলতি রেমিট্যান্স আয় ব্যবহার করার পরও চলতি আমদানি ব্যয়ের পুরোটা মেটানো যাচ্ছে না।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আমদানি ব্যয় ব্যাপকভাবে সংকোচনের নীতি গ্রহণ করে। ধারণা করা হয়, আমদানি কমানো হলে মার্কিন ডলারের ওপর চাপ হ্রাস পাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের এক রকম মূল্য দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু কার্ব মার্কেটে ডলারের মূল্য অনেক বেশি। বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স অর্থের ওপর মার্কিন ডলারের বিনিময় হার যেখানে ১০৭ টাকা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের বিপরীতে পাওয়া যায় ১২০ টাকা। স্বাভাবিক সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেল এবং কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় হারের মধ্যে ১ থেকে ২ টাকা পার্থক্য থাকত। কিন্তু এখন সেই পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১৩ থেকে ১১ টাকা। এর ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে তাদের উপার্জিত অর্থ দেশে প্রেরণ করতে থাকে। ফলে স্বচ্ছ রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাপকভাবে কমে যায়। তার অর্থ কিন্তু এই নয়, প্রবাসী বাংলাদেশিরা আগের মতো রেমিট্যান্স প্রেরণ করছেন না। তারা রেমিট্যান্স প্রেরণ করছেন, কিন্তু তা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আসছে না। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মসংস্থান উপলক্ষ্যে বিদেশে যাচ্ছেন। তারা তাদের উপার্জিত অর্থ স্থানীয় সুবিধাভোগীদের কাছে প্রেরণ করছেন; কিন্তু সেগুলো হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে যুক্ত হচ্ছে না। ব্যাংকিং চ্যানেলে আগে যে রেমিট্যান্স দেশে আসত, তা দিয়ে কারেন্ট অ্যাকাউন্টসের চাপ মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অংশ দিয়ে রিজার্ভ বাড়ানো হতো, সেটি কমে গেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে কে এমন আছেন, যিনি ১৩ টাকা কম পাওয়ার জন্য ব্যাংকিং চ্যানেল দিয়ে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করবেন? অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, হুন্ডির মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স দেশে আসছে, তা দিয়ে তো ব্যবসায়ীরা তাদের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারেন-তাই নয় কি? কিন্তু সেটা কতটুকু হচ্ছে-তা আমরা জানি না, কারণ এটি বেআইনি পথে যাতায়াত করে। কাজেই সেই অর্থ দিয়ে আমদানির জন্য এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলা যাচ্ছে না। তাহলে হুন্ডিওয়ালাদের নানামুখী সমস্যায় পড়তে হতে পারে। এমন হতে পারে-হুন্ডির মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্স তারা হয়তো রেখে দিচ্ছেন পাচারের উদ্দেশ্যে বা হয়তো নিছক স্পেকুলেটিভ ট্রেডের জন্য। স্পেকুলেটিভ ট্রেডের চাহিদা যখন বৃদ্ধি পায়, তখন সবাই হিসাব করতে থাকে ডলারের মূল্য আরও বেড়ে যাবে কিনা। যদি তারা মনে করেন, ডলারের বিনিময় হার আরও বৃদ্ধি পাবে এবং স্থানীয় মুদ্রার আরও অবমূল্যায়ন ঘটবে, তাহলে তারা ডলার রেখে দেওয়ার চেষ্টা করবে। তারা কম টাকায় ডলার কিনে বেশি দামে ডলার বেচতে থাকে। কিন্তু সেই ডলার আর উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয় না।
আমার ধারণা, মূলত এ কারণেই রেমিট্যান্সের সংকট রয়ে যাচ্ছে। হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসা ডলার স্পেকুলেটিভ ব্যবসায় খাটছে। আরেকটা কারণ, হয়তো ওই ডলারটা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। অনেকেই মনে করছেন, আমি আমার সম্পদ স্থানীয় মুদ্রায় না রেখে ডলারে সংরক্ষণ করি। সরকার এখন হন্যে হয়ে ডলার খুঁজছে। তাই অনেকেই অধিক নিরাপত্তার স্বার্থে ডলার বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বলে আমার ধারণা। বিদেশে থেকে মার্কিন ডলার হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসছে। আবার হুন্ডির মাধ্যমেই দেশ থেকে বেশি ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে মার্কিন ডলারের সংকট আছে, এটি কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।
তবে সরকার যদি কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, তাহলে পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি হতে পারে। এর মধ্যে প্রথমেই হুন্ডি ব্যবসায়ীদের তৎপরতা বন্ধ করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য ব্যাংক রেট এবং কার্ব মার্কেটে ডলারে রেটের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, তা কমিয়ে আনতে হবে। এটা করা গেলে ডলার সংকট অনেকটাই দূরীভূত হবে। এখন মার্কেটের রেটের সঙ্গে সংগতি রেখে ৩ মাস পরপর ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার নির্ধারণ করা হয়। মার্কিন ডলারের বিনিময় হারের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। কার্ব মার্কেটে ডলারের যে বিনিময় হার থাকে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাংকিং চ্যানেলে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করা যেতে পারে। প্রতি তিন মাস অন্তর ব্যাংকিং চ্যানেলের সঙ্গে কার্ব মার্কেটের রেটের ব্যবধান এক শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে আনা যেতে পারে। কোনোভাবেই ব্যাংকিং চ্যানেল এবং কার্ব মার্কেটের ডলারের মূল্যের যে পার্থক্য তা বাড়তে দেওয়া যাবে না। যেমন তিন মাস পর কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১২০ টাকা থেকে বেড়ে হয়তো ১২২ টাকা হয়েছে। তাহলে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি ডলারের বিনিময় হার অন্তত ১১০ থেকে বাড়িয়ে ১১২ টাকা বা আরও ভালো হয় ১১৩ টাকা করতে পারলে। এভাবে ক্রমাগত করা হলে কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের মূল্যে যে পার্থক্য তা ধীরে ধীরে কমে আসবে। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) পরামর্শ হচ্ছে, কার্ব মার্কেট এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের বিনিময় হারের মধ্যে যে পার্থক্য বিদমান আছে, তা একবারে কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু এটা এক স্টোকে করা হলে মূল্যস্ফীতি রাতারাতি ব্যাপকভাবে বেড়ে যেতে পারে। তাই একবারে না করে কার্ব মার্কেট এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের বিনিময় হারের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, তা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও তা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে।
জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যায় বলে একটি অভিযোগ শোনা যায়। আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগেও কি অর্থ পাচার বৃদ্ধি পাবে? আমাদের দেশ থেকে অর্থ পাচার সব সময়ই হচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেও তা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে নির্বাচনের আগে দু’ভাবেই অর্থ পাচার হতে পারে। যারা বিদেশে অর্থবিত্তের মালিক, তারা তাদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে জেতানোর জন্য বিদেশ থেকে ডলার দেশে প্রেরণ করবে। আর যারা স্থানীয়ভাবে নানা উপায়ে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন, তাদের মিত্রদের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার ভয় থাকলে এ সময় দেশ থেকে ডলার বিদেশে পাচার করতে তারা সচেষ্ট হবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির সম্পত্তি আটক করার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এটি কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, বাংলাদেশিদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে গিয়ে সম্পদ ক্রয় করে বসবাস করছেন। এসব দেশ যদি অবৈধভাবে সম্পদ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে আমাদের কিছু বলার নেই। তবে যাই করা হোক না কেন, তা যেন সঠিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে করা হয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে এমন একটি উদ্যোগ কেন গ্রহণ করল? অতীতে তো এমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি? তারা অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে তো এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি? তাহলে কি বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে কোনো বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসাবে এটি করা হয়েছে? (অনুলিখন: এমএ খালেক)
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়