আলেমা হাবিবা আক্তার
রুফাইদা বিনতে সাআদ আল আনসারিয়া (রা.) ছিলেন মুসলিম ইতিহাসের প্রথম নারী চিকিৎসক। মহানবী (সা.)-এর সময় মসজিদ-ই-নববীতে তাঁর নিজস্ব চিকিৎসা কেন্দ্র ছিল এবং তিনি যুদ্ধাভিযানে মুসলিম চিকিৎসকদলের নেতৃত্ব দিতেন। একজন কারি (উত্তমরূপে কোরআন তিলাওয়াতকারী) ও লিপিকার হিসেবেও তাঁর পরিচিতি ছিল। তিনি তাঁর জীবনের সব সম্পদ মানুষের চিকিৎসাসেবা প্রদানে এবং অসহায় নারী ও শিশুদের প্রতিপালনে ব্যয় করেন।
রুফাইদা আসলামিয়া (রা.) মদিনার খাজরাজ গোত্রের আসলামিয়া শাখায় জন্মগ্রহণ করেন। এজন্য তাঁকে আসলামিয়া বলা হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সাআদ আসলামি (রা.) ছিলেন মদিনার একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ চিকিৎসক। পিতার কাছ থেকেই তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের দীক্ষা নেন। তিনি শৈশব থেকে পিতার চিকিৎসাসেবার কাজে সহযোগী ছিলেন।
নবীজি (সা.) তাঁকে মসজিদ-ই-নববীতে একটি তাঁবু স্থাপনের অনুমতি দেন, যা ‘খিমাতু রুফাইদা’ নামে পরিচিত ছিল। এটাকেই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম চিকিৎসাকেন্দ্র বলা হয়। তিনি সেখানে মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতেন। রুফাইদা (রা.) শুধু নিজে চিকিৎসা দিতেন না, বরং তিনি মুসলিম নারীদের প্রাথমিক চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও রোগী যতœ নেওয়ার পদ্ধতি শেখাতেন। তাঁর প্রচেষ্টায় মদিনায় নারীদের একটি স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসকদল তৈরি হয়েছিল। যারা স্থানীয় পর্যায়ে ও যুদ্ধের সময় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করত।
যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলমান ও যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা দিতে রুফাইদা (রা.) একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
তিনি নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে বদর, ওহুদ, খন্দক, খাইবারসহ অন্যান্য যুদ্ধে অংশ নেন। রুফাইদা (রা.) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সময় তাঁর তাবু, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণ সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। মুসলিম বাহিনীর অবস্থানস্থলের কাছেই তাঁর তাবু স্থাপন করা হতো। রুফাইদা (রা.)-এর তাঁবুটিই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ‘ফিল্ড হাসপাতাল’। রুফাইদা (রা.) শুধু রোগীদের চিকিৎসা দিতেন না, বরং তিনি নিজেও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন, বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতেন। যুদ্ধের ময়দানে কোনো মুসলিম আহত হলে বীরবিক্রমে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতেন এবং চিকিৎসা দিতেন। এজন্য তাঁর উপাধি দেওয়া হয়েছিল ‘ফিদাইয়াহ’ বা আত্মোৎসর্গকারী।
রুফাইদা (রা.) তাঁর তাঁবুতে রোগীদের অস্ত্রোপচার ও অঙ্গবিচ্ছেদের মতো সেবা প্রদান করতেন। মুমূর্ষু রোগীদের মরুভূমির উত্তাপ ও রুক্ষ আবহাওয়া থেকে রক্ষার বিশেষ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এছাড়া তিনি মানুষকে রোগব্যাধি ও তার কারণ সম্পর্কে সতর্ক করতেন এবং তাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিতেন। দরিদ্র ও অসহায় মানুষই ছিল তাঁর মনোযোগের কেন্দ্র। স্বাস্থ্যসেবায় তাঁর কর্মতৎপরতার সঙ্গে আধুনিক যুগের ‘সামাজিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম’ ধারণার মিল পাওয়া যায়।
আল্লামা ওয়াকিদি (রহ.) তাঁর সম্পর্কে লেখেন, ‘রুফাইদা বিনতে সাআদ (রা.) আহতদের চিকিৎসা দিতেন, ভবঘুরে ও অসহায়-যাদের কেউ নেই তাদের পাশে দাঁড়াতেন, মসজিদের ভেতর তাঁর চিকিৎসা তাঁবু ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) সেখানে সাআদ (রা.)-কে নিয়ে আসেন।’ (কিতাবুল মাগাজি : ২/৫১০)
রুফাইদা আসলামিয়া (রা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ইউনিভার্সিটি অব বাহরাইন তাঁর নামে সম্মানজনক নার্সিং অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করেছে। পাকিস্তানে ‘দ্য রুফাইদা আল-আসলামিয়া নার্সিং স্কুল’ স্থাপন করা হয়েছে। এটি রাওয়ালপিণ্ডি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান।