কুলসুম রশীদ: বড়পির মহিউদ্দিন হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) ৪৭১ হিজরিতে জন্ম গ্রহণ করেন। ৫৬১ হিজরির ১১ রবিউস সানি তিনি ইন্তেকাল করেন। আধ্যাত্মবাদের গুরু গাউসে পাক হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) তাওহিদ বা আল্লাহ্র একত্ববাদে বিশ্বাসের তালিম দিয়ে এরশাদ করেন ‘যিনি তোমাকে হামেশা দেখিয়েছেন তার দিকে নজর ফিরিয়ে রাখ, যিনি তোমার সম্মুখে রয়েছেন তাকে সর্বদা সম্মুখে রাখ। যিনি তোমাকে ভালোবাসছেন, তুমি তাহাকে ভালোবাস, যিনি তোমাকে আহ্বান করেছেন, তুমি তার ডাকে সাড়া দাও। যিনি তোমাকে রক্ষা করেছেন, তুমি তার হস্তে নিজেকে সোপর্দ কর।’
মুসলিম জাতির পতনোন্মুখ সময়ে তাঁর আবির্ভাব ঘটে জিলান নগরে ৪৭১ হিজরিতে। তাঁর বংশসূত্র হযরত আলী (রা.) পর্যন্ত পৌঁছে। তিনি মুসলমানদের জীবন থেকে পথভ্রষ্টতার করাল ছায়ার মূলোৎপাটন করে মুমূর্ষু ইসলামকে নবজীবন দান করেন। তাই তাঁর খেতাব ছিল, ‘মুহিউদ্দীন’ অর্থাৎ ইসলামকে নবজীবনদানকারী।
তিনি এরশাদ করেছেন যাবতীয় গুণাবলির মূল সমষ্টি হলো জ্ঞান অর্জন। আর সেই মোতাবেক আমল বা তার বাস্তবায়ন অপরকে শিক্ষা দেওয়া, বক্তব্য প্রদান করেই হযরত ক্ষান্ত হননি। নিজের পবিত্র জীবনে তা বাস্তবায়ন করে গেছেন। প্রথমে জ্ঞান অন্বেষণ এবং পরে প্রেমময় মহান রাব্বুল ইজ্জতের মারেফাত লাভের উদ্দেশ্যে কঠোর সাধনা করেন। ১৮ বছর বয়সে উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদ শহরে ৪৮৮ হিজরিতে আগমন করেন। সেই যুগের বিভিন্ন জ্ঞানী ব্যক্তিদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে হাদিস, তাফসির, ফিকাহ, লোগাত, শরিয়ত, তরিকত এক কথায় সব বিষয়ে পারদর্শী হন। নেজামিয়া মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন।
তার পাণ্ডিত্যের মোকাবিলা করার মতো কেউ ছিল না। মহান রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তিনি আধ্যাত্ম সাধনায় মনোনিবেশের ব্যাপারে তার উক্তি ‘একটানা ২৫ বছর ইরাকের বন-বাদাড়ে আর প্রান্তরগুলোয় এভাবে কাটিয়েছি যে, আমাকে তখন কেউ চিনত না আর আমিও কারও সঙ্গে সম্পর্ক রাখতাম না। ৪০ বছর এশার ওজু দিয়ে ফজর পড়েছি। অর্থাৎ সারা রাত এক মুহূর্তের জন্যও চোখের পাতা এক করিনি। আর পনেরো বছর পর্যন্ত প্রতি রাতেই নামাজের মধ্যে এক খতম কুরআন পাঠ করেছি।
এমনও সময় কেটেছে যে, তিন থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত না কোনো পানাহার করতে পেরেছি আর না ঘুম বা বিশ্রাম গ্রহণের সুযোগ হয়েছে। হযরত গাওসুল আজম (রহ.)-এর বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানচর্চাকারী শায়খ আবু সাঈদ মাখজুমি (রহ.)-এর প্রদত্ত মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এর উন্নতি ও উৎকর্ষের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পাশাপাশি ওয়াজ নসিহত ও তাবলিগের কাজের জন্য তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বে। মাদ্রাসার নামকরণ করা হয় ‘মাদ্রাসায়ে কাদেরিয়া’। ৫৬১ হিজরিতে এ মাদ্রাসার সন্নিকটে সমাহিত হন। মজলিশে আগত মুসল্লিদের মনের দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ দূর হয়ে যেত।
উপস্থিত প্রতিটি ব্যক্তির মনে হতো হযরত আমার প্রতিই বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখছেন এবং আমাকে উদ্দেশ্য করেই কথা বলছেন। তার ওয়াজে প্রভাবিত হয়ে প্রচুর মানুষ তওবা করে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিত। মজলিশের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করার জন্য ৪০০ ব্যক্তি নিযুক্ত থাকতেন। শনি ও মঙ্গলবার মাদ্রাসায় আর রোববার খানকায়। উপস্থিতিদের সংখ্যা সময়ে ৭০ হাজার পেরিয়ে যেত। গাওসুল আজম (রহ.)-এর কাছে যারা শরিয়ত এবং মারেফাতের জ্ঞান লাভ করেছেন তাদের সংখ্যা অসংখ্য।
তিনি ছিলেন জ্ঞান সমুদ্র। আগত ব্যক্তিরা জ্ঞানপিপাসা নিবারণ করে লাভবান হয়েছেন। তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ ছিল বিস্ময়কর এর ফলে অগণিত বিপদগ্রস্ত মানুষ মুক্তি লাভ করত। বড়পীর মহিউদ্দিন হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) বলেন মু’মিন ব্যক্তি নির্ভরশীল হয় আল্লাহ্র ওপর। আর মুনাফেক নির্ভর করে ধন-সম্পদের ওপর। যে ব্যক্তি নিজেকে শিক্ষা দিতে পারে না, সে অপরের শিক্ষক হবে কীভাবে? যে আল্লাহ্কে ভয় করে সে বিনয়ী হয়। যে সৃষ্টির প্রতি দয়া করে, সেই স্রষ্টার নৈকট্য লাভে সক্ষম হয়। [ফুতুহুল গায়েব]