নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রহস্যময় জীবন

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রহস্যময় জীবন

রণক ইকরাম
মাকে লেখা চিঠি
সুভাষচন্দ্র বসু খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯১৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে গোটা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ফলে তিনি কুড়ি টাকা বৃত্তি পেলেন। কিন্তু এই বৃত্তির টাকা তিনি নিজে খরচ না করে দিন-দুঃখীর সেবায় দান করলেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার পর নেতাজি তাঁর মাকে একটি চিঠি লিখেন। সেই চিঠির শেষের অংশটিতে তিনি লিখেন-
… আমি যদি না পড়িয়া এ স্থান পাই তবে যাহারা লেখাপড়াকে উপাস্য দেবতা মনে করিয়া তজ্জন্য প্রাণপাত করে তাহাদের কী অবস্থা হয়? তবে প্রথম হই আর লাস্ট হই আমি স্থিররূপে বুঝিয়াছি লেখাপড়া ছাত্রের উদ্দেশ্য নহে-বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চাপ্রাস’ (ডিগ্রি) পাইলে ছাত্ররা আপনাকে কৃতার্থ মনে করে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চাপ্রাস’ (ডিগ্রি) পাইলে যদি কেহ প্রকৃত জ্ঞান না লাভ করিতে পারে- তবে সে শিক্ষাকে আমি ঘৃণা করি। তাহা অপেক্ষা মূর্খ থাকা কি ভালো নয়? চরিত্র গঠনই ছাত্রের প্রধান কর্তব্য- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা চরিত্র গঠনকে সাহায্য করে-আর কার কিরূপ উন্নত চরিত্র তাহা কার্যেই বুঝিতে পারা যায়। কার্যই জ্ঞানের পরিচায়ক। বইপড়া বিদ্যাকে আমি সর্বান্তকরণে ঘৃণা করি। আমি চাই চরিত্র-জ্ঞান-কার্য। এই চরিত্রের ভিতরে সবই যায়- ভগবদ্ভক্তি, – স্বদেশপ্রেম, – ভগবানের জন্য তীব্র ব্যাকুলতা সবই যায়। বই পড়া বিদ্যা তো তুচ্ছ সামান্য জিনিস- কিন্তু হায় কত লোকে তাহা লইয়া কত অহঙ্কার করে।

দুনিয়া কাঁপানো গোপন নথি
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কিত ১০০টি গোপন নথি প্রকাশ করা হয়েছে। দিল্লিতে ন্যাশনাল আর্কাইভস অব ইন্ডিয়ায় (এনএআই) নেতাজির ১১৯তম জন্মবার্ষিকীতে ২০১৬ সালে এসব নথির ডিজিটাল সংস্করণ প্রকাশ পায়। নেতাজিকে নিয়ে ব্রিটিশ ও মার্কিন গোয়েন্দাদের যৌথ প্রতিবেদনের একটি নথি থেকে জানা যায়, ১৯৪৮ সালে স্বাধীন ভারতবর্ষে এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি জীবিত ছিলেন ১৯৪৫ সালে তাইহোকুর তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনার পরও। নেতাজিকে নিয়ে প্রকাশিত এসব নথিতে একদিকে যেমন সামরিক হাসপাতালে নেতাজির অন্তিম মুহূর্তগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী জুইসি নাকামুরার বক্তব্য উঠে এসেছে, ঠিক তেমনি ১৯৬২ সালে জওহরলাল নেহরু কর্তৃক নেতাজির স্বজনদের কাছে তাঁর মৃত্যু সংবাদ পৌঁছার বিষয়টিও প্রকাশ পেয়েছে। নথি থেকে জানা যায়, ভারত সরকার নেতাজির মেয়েকে ছয় হাজার রুপি মাসোয়ারা হিসেবে দিত। তবে ১৯৬৫ সালে তার বিয়ের পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে নেতাজির স্ত্রীকে এ মাসোয়ারা প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। নথি থেকে জানা গেছে, মৃত্যুর আগে নেতাজির শেষ বক্তব্য ছিল, ‘আমি ঘুমাতে চাই।’ এর আগের বছর নেতাজি নিখোঁজ হওয়ার ৭০ বছরপূর্তিতে তাঁর সম্পর্কিত ৬৪টি গোপন নথি প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। দুটি তদন্ত কমিশন তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানের তাইপেতে এক বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি মারা যান। কিন্তু তৃতীয় আরেকটি তদন্ত কমিশন ও নেতাজির বেশ কয়েকজন আত্মীয়সহ অনেকে বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যই রয়ে গেছে।
সুভাষচন্দ্রের নেতাজি হয়ে ওঠা
সুভাষচন্দ্র পরপর দুবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত এবং কংগ্রেসের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করার জন্য তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। এর মধ্যেই তিনি ফরওয়ার্ড ব্ল¬ক নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানাতে থাকেন। কলকাতায় প্রবল জনমত সৃষ্টি করলে ইংরেজ সরকার ভীত হয়ে ১৯৪০ সালের ২ জুলাই নেতাজিকে গ্রেফতার করে এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে তাঁকে আটকে রাখে। ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে গৃহবন্দি অবস্থায় পালিয়ে আফগানিস্তান হয়ে রাশিয়ার পথে যাত্রা করেন। সেখানে ভারতের স্বাধীনতার জন্য সোভিয়েত শক্তির সমর্থন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরেন। এরপর গোয়েন্দা নজরদারি এড়ানোর জন্য মৌনব্রত ও নির্জনবাসের ঘোষণা দেন। ওই সুযোগে তিনি মৌলভি জিয়াউদ্দীনের মতো দাড়ি রাখেন ও তার মতোই পোশাক পরে গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ পালিয়ে আফগানিস্তান ও মস্কো হয়ে জার্মানির বার্লিন পৌঁছেন। তিনি জার্মানি থেকে সাবমেরিনযোগে জাপান পৌঁছেন। জাপান-অধিকৃত সিঙ্গাপুরে রাসবিহারী বসুর তত্ত্বাবধানে ভারতীয় উপমহাদেশের যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে ‘আজাদ-হিন্দ ফৌজ’ গঠন করেন এবং এর সর্বাধিনায়ক হন।
১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘ফরওয়ার্ড ব্ল¬ক’ দলকে বেআইনি ঘোষণা করে। সমগ্র ভারতজুড়ে ‘ফরওয়ার্ড ব্ল¬ক’ দলের সব পার্টি অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৪৩ সালে নেতাজি জাপানে যান। এরমধ্যে আরেক ভারতীয় বিপ্ল¬বী রাসবিহারী বসু, প্রবাসে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনীর নাম ছিল ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী। ১৯৪৩ সালের ৪-৭ জুলাই সিঙ্গাপুরস্থ মহাএশিয়া মিলনায়তনে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রধান নেতৃবৃন্দের মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট বিপ্ল¬বী রাসবিহারী বসু দাঁড়িয়ে সভায় নতুন অতিথি হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুকে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সঙ্গে লীগের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুভাষ বসুকে স্থলাভিষিক্ত করার জন্য নিজের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন। এরপর সভার নেতৃবৃন্দ এবং সদস্যরা করতালি দিয়ে সুভাষ বসুকে স্বাগত জানান। রাসবিহারী বসু প্রবাসে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিচালক নির্বাচিত হওয়ার কারণে সুভাষ বসুকে ‘নেতাজি’ উপাধি ঘোষণা করেন। রাসবিহারী বসুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এই মহাসভায় সুভাষচন্দ্র বসু দুই ঘণ্টাব্যাপী এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন।
বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়নি!
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যুরহস্য এ উপমহাদেশের অমীমাংসিত রহস্যগুলোর অন্যতম। যদিও সবাই জানে, বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে- কিন্তু আসলে মূল ঘটনা তেমন নয়। তিনি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হননি বলে জানিয়েছেন এক ব্যক্তি। নেতাজির গাড়িচালক দাবিদার ওই ব্যক্তি জানিয়েছেন, যে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি নিহত হয়েছেন বলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত, সে ঘটনার চার মাস পর তিনি নেতাজিকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। ১০৭ বছর বয়সী এই ব্যক্তির নাম নিজামুদ্দিন। পেশায় গাড়িচালক নিজামের বাড়ি আজমগড় জেলার বিলাড়িগঞ্জ এলাকার ইসলামপুরে। তিনি নিজেকে নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের একজন সদস্য হিসেবে দাবি করেছেন। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে নেতাজি ১৯৪২ সালে এ বাহিনী গঠন করেন। একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজামুদ্দিন বলেন, তিনি নিশ্চিত নেতাজি কোনোভাবেই ১৯৪৫ সালের বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ওই বিমান দুর্ঘটনার তিন থেকে চার মাস পর তিনি নেতাজিকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছ দিয়ে প্রবাহিত সিতাংপুর নদীর তীরে নামিয়ে দিয়ে গেছেন। নেতাজি যে গাড়ি থেকে সেখানে নেমেছেন সেটার চালক ছিলেন তিনি নিজে। তাহলে তিনি বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন কীভাবে? নদীর তীরে নেমে যাওয়ার পর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভাগ্যে কী ঘটেছিল সে ব্যাপারে তিনি আর কিছুই জানেন না বলে জানান। নিজামুদ্দিন বলেন, তিনি নেতাজির সান্নিধ্য পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন। অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে যাওয়ার আগে তিনি আবার স্বাধীন ভারতে ফেরার অঙ্গীকার করেছিলেন।
শুধু তাই নয়, নিজামুদ্দিন দাবি করেন- নেতাজির ঘনিষ্ঠ সহচর এস ভি স্বামীর সঙ্গেও তার বৈঠক হয়েছিল। স্বামী ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। নিজামুদ্দিন তার দাবির স্বপক্ষে সে সময় তাকে দেওয়া প্রত্যাবাসন সনদ দেখান। আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকার এটিই একমাত্র প্রমাণ। কেবল নিজামুদ্দিনই নন, নেতাজিকে নিয়ে প্রকাশিত ভারতের নথিগুলোর মধ্যেও বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু না হওয়ার প্রমাণ মিলেছে বলে জানা গেছে। তবে এরপর তিনি কোন বেশে কী পরিচয়ে কোথায় তাঁর জীবন কাটিয়েছেন, সেটা আজও রহস্য। এখনো নেতাজি সংক্রান্ত বেশ কিছু নথি প্রকাশের বাকি আছে। কে জানে হয়তো তখন এ সংক্রান্ত রহস্যের সমাধান মিললেও মিলতে পারে। অথবা এটি চিরকালের মতো ভারতবর্ষের সেরা অমীমাংসিত রহস্যগুলোর একটি হয়েই রয়ে যাবে।
কত্ত রকম ধারণা!
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই কিংবদন্তি নেতার মৃত্যুটা ঠিক কীভাবে হয়েছিল, তা আজও বিশ্ববাসীর কাছে অজানা। কেউই এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে বলতে পারেননি। তাঁর এই রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে অনেকেই অনেক মত প্রকাশ করেছেন। ধারণা করা হয়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট টোকিও যাওয়ার পথে, তাইওয়ানে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। তবে তাঁর মৃত্যুর সঠিক তারিখ ও স্থান সম্পর্কে এখনো বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তাঁর দেহাবশেষ কোনো দিনও উদ্ধার করা যায়নি। একটি মতে, নেতাজি সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে বন্দি অবস্থায় সাইবেরিয়াতে মৃত্যুবরণ করেন। এখানেও যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর একটি মতে, বর্তমানে রেনকোজি মন্দিরে রাখা নেতাজির চিতাভস্ম পরীক্ষা করে জানা গেছে- ওই চিতাভস্ম নেতাজির নয়। আসলে ভারতবর্ষে নেতাজির তুমুল জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একদল উঁচুতলার ভারতীয় নেতা এবং ইংরেজ সরকার মিলিতভাবে ষড়যন্ত্র করে নেতাজিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। তাই ভারতীয় সরকার কখনো নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রকৃত মৃত্যুর কারণ জনসমক্ষে আনেনি। অনেকের মতে, ফোইজাবাদের ভগবানজি ওরফে গুনমানি বাবা হলেন নেতাজি। কিন্তু এ ব্যাপারটি আজও স্পষ্ট নয়।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *