দেওয়ানবাগ ডেস্ক: ২০২৩ সালে নোবেলজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান, শান্তি এবং অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন চার নারী।
কাতালিন কারিকো
প্রাণরসায়নবিদ, চিকিৎসাশাস্ত্র
করোনা ভাইরাস মহামারি পৃথিবীকে দুভাগে ভাগ করেছে। একটাকে বলা হচ্ছে প্রি-কোভিড ওয়ার্ল্ড (মহামারির আগের পৃথিবী) ও পোস্ট-কোভিড ওয়ার্ল্ড মহামারির পরের পৃথিবী)। কোভিড-১৯ এমন এক ছাপ রেখে গেছে, ২০১৯-এর আগে ও পরের পৃথিবী স্পষ্টতই ভিন্ন দুই জগৎ যেন। লাখে লাখে মানুষ মারা গেছে নানা দেশে।
মহামারির সময় বিজ্ঞানীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাদের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে করোনার প্রতিষেধক উদ্ভাবনের আশায়। অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। সফল যে কয়জন হয়েছেন, তাদের মধ্যে একজন কাতালিন কারিকো। তিনি অপ্রদাহী এমন এক এমআরএনএ (মেসেঞ্জার রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) আবিষ্কার করেন, যা দ্রুত করোনা টিকা উদ্ভাবনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এর স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০২৩ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এ ধরনের বিজ্ঞানীরা সংবাদ ও প্রচারের আড়ালেই থেকে যান; কিন্তু নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সুবাদে সারা দুনিয়া তাদের চিনতে পারে। কৃতিত্ব সম্পর্কে জানার পর মানুষ মন থেকে শ্রদ্ধা জানায়।
অধ্যাপক কারিকোর বৈজ্ঞানিক জীবন শুরু মাতৃভূমি হাঙ্গেরিতে। কারিকোর জন্ম ১৯৫৫ সালের ১৭ জানুয়ারি। যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান ১৯৮৫ সালে। পেনসিলভানিয়া টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে তিনি পেশাজীবন শুরু করেন। পাঁচ বছর পর তিনি ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় যোগ দেন। জেনেটিক থেরাপির জন্য আরএনএ মেসেঞ্জার ব্যবহারের গবেষণায় তিনি সেখানে তহবিল সংগ্রহ ও গবেষণা শুরু করেন। জার্মান কোম্পানি বায়োএনটেকে আরএনএ থেরাপিউটিকসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি দায়িত্ব নেন ২০১৩ সালে। এখানে তিনি এমআরএনএভিত্তিক টিকা উদ্ভাবনের গবেষণায় মনোনিবেশ করেন এবং কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে প্রথম এমআরএনএ টিকা উদ্ভাবন করেন। স্বীকৃতিস্বরূপ প্রাণরসায়নবিদ এবার চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। একই গবেষণা ও সাফল্যের জন্য তার সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পেয়েছেন তারই সহকর্মী বিজ্ঞানী ড্রিউ উইসম্যান।
অ্যানলিয়ের পদার্থবিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞান
দ্য নোবেল প্রাইজ নামে ভেরিফায়েড পেজে অ্যানলিয়েরকে ফোনে কথা বলার একটি ছবি পোস্ট দিয়ে বলা হয়েছে, ‘একজন নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক! ২০২৩ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অ্যানকে তার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আলাদা করা যায়নি। আমাদের নতুন নোবেল বিজয়ী ক্লাসে পড়াতে ব্যস্ত ছিলেন। ক্লাসের নির্ধারিত বিরতির সময় তিনি খবরটি শুনেছেন। ফোনকলের পর তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে আবার ফিরে যান।’
নোবেল কমিটি সামাজিক মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) এ পোস্ট করেছিল। পোস্টে যাকে উল্লেখ করা হয়েছে, অ্যানলিয়ের হচ্ছেন সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। ২০২৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে যে তিন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের একজন অ্যানলিয়ের। অন্য দুজন হলেন যুক্তরাষ্ট্রের পিয়ের আগোস্তিনি ও হাঙ্গেরির ফেরেন্স ক্রাউজ। পদার্থের ভেতরে ইলেকট্রন কীভাবে শক্তি বিনিময় করে, সেই রহস্য উন্মোচনে গবেষণার জন্য তারা এ নোবেল পেয়েছেন।
ফ্রান্সের পিয়েরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে তিনি পিএইচডি অর্জন করেন। সুইডেনে পোস্টডক্টরাল গবেষণা করেছেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ফ্রেঞ্চ অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনে গবেষক হিসাবে চাকরি করেছেন। এরপর তিনি লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। ১৯৯৭ সাল থেকে সেখানে অ্যাটোমিক ফিজিক্সের অধ্যাপক তিনি। এ পদার্থবিজ্ঞানীর জন্ম ১৯৫৮ সালের ১৬ আগস্ট, প্যারিসে।
নার্গিস মোহাম্মদি
মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী, শান্তি
ইরানের কারাবন্দি নার্গিস মোহাম্মদি এ বছর শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। ইরানে নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুক্তির লড়াইয়ে সাহসের সঙ্গে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার কৃতিত্বস্বরূপ এবার শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন নার্গিস মোহাম্মদি। তিনি ইরানের মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী। ৫১ বছর বয়সি এ নেতা এখন তেহরানের সবচেয়ে কুখ্যাত এভিন কারাগারে বন্দি আছেন। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা চালানোসহ নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে। তাকে ১০ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে।
নোবেল শান্তি কমিটি বলেছে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে মোহাম্মদির এ সংগ্রামে ‘ব্যক্তিগতভাবে চরম খেসারত’ গুনতে হয়েছে নার্গিস মোহাম্মদিকে; কিন্তু তিনি ইরানে নারীদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও সবার অধিকার নিশ্চিত করতে আপসহীন আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তার আন্দোলনের মূলকথা ‘নারী, জীবন ও স্বাধীনতা’।
নারীদের লক্ষ্য করে বৈষম্য ও নিপীড়নের নীতির বিরুদ্ধে যে হাজার হাজার ইরানি বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, সেই গণবিক্ষোভে নার্গিস মোহাম্মদি নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৩ সালে শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন ইরানের শিরিন এবাদি। তার ডিফেন্ডারস অব হিউম্যানরাইটস সেন্টারে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে রয়েছেন নার্গিস মোহাম্মদি। তার জন্ম ১৯৭২ সালের ২১ এপ্রিল।
ক্লডিয়া গোলডিন
অর্থনীতিবিদ, অর্থনীতি
অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ক্লডিয়া গোলডিন। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে নোবেল কমিটি।
ক্লডিয়া গোলডিনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের পরিণতিতে কী ঘটছে, সেই বিষয়ে আমাদের বোঝাপড়া উন্নত করেছেন তিনি। ২০০ বছর সময়ে নারীর শ্রমশক্তিকে অংশগ্রহণ ও তাঁদের আয় নিয়ে গবেষণা করেছেন গোলডিন। মূলত যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ নিয়ে তিনি এ গবেষণা করেন। বলা হচ্ছে, এ বিষয়ের প্রথম পূর্ণাঙ্গ চিত্র এঁকেছেন তিনি। দেখিয়েছেন, নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যবধান সব সময়ই ছিল; যদিও একেককালে তা ছিল একেক রকম। এই যে নারী-পুরুষের ব্যবধান এবং তার রূপের পরিবর্তন, ক্লডিয়া গোলডিনের গবেষণায় তার কারণ উন্মোচিত হয়েছে। একধরনের মডেল দিয়েছেন তিনি।
নোবেল প্রাইজ ডট অর্গে বলা হয়েছে, অনেক উচ্চ আয়ের দেশে গত এক শতকে বেতন-মজুরিভিত্তিক কাজে নারীর অংশগ্রহণ তিন গুণ হয়েছে। আধুনিক সময়ের ইতিহাসে এটি অন্যতম বৃহৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন, কিন্ত তা সত্ত্বেও নারী-পুরুষের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান রয়ে গেছে। গত শতকের আশির দশকে ক্লডিয়া গোলডিন এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা শুরু করেন।
ক্লডিয়া গোলডিনের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মূল বিষয় হচ্ছে, আগে এবং এখনো নারীর সিদ্ধান্ত মূলত তাঁর বিয়ে ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের নিরিখে নির্ধারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। মূলত, যুক্তরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করলেও তাঁর অন্তর্দৃষ্টি কাল-সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে যায়।
তবে ক্লডিয়া গোলডিনের কাজ খুব সহজ ছিল না। রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, একসময় সরকারি পরিসংখ্যানে শুধু পুরুষদের কাজের তথ্য-উপাত্ত থাকত, নারীদের থাকত না। ফলে অভিলেখাগার বা আর্কাইভে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে; রীতিমতো তথ্য গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। অভিলেখাগারের বিপুল তথ্যভান্ডার ঘেঁটে তাঁকে বের করতে হয়েছে, নারীর ভূমিকা কী ছিল।
আরেকটি কারণে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিপ¬বাত্মক পরিবর্তন এসেছে। সেটা হলো, জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী। এটা নারীকে ক্যারিয়ার নিয়ে পরিকল্পনা করার সুযোগ দিয়েছে, অর্থাৎ স্বাধীনতা দিয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, নারী-পুরুষের আয়ের বৈষম্যের পেছনে শিক্ষা ও পেশার ভূমিকাই মুখ্য। গোলডিন দেখাচ্ছেন, আগের সেই জামানা আর নেই। এখন দেখা যায়, একই পেশায় নারী ও পুরুষের মধ্যে বেতনের পার্থক্য তৈরি হচ্ছে; যে ব্যবধানের সূত্রপাত হয় নারীর প্রথম সন্তান জন্মলাভের পর।
দ্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের কমিটি ফর দ্য প্রাইজ ইন ইকোনমিক সায়েন্সেসের চেয়ারম্যান জেকব স্ভেনসন বলেছেন, ‘শ্রমশক্তিতে নারীর ভূমিকা বোঝা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ক্লডিয়া গোলডিনের এই উদ্ভাবনী কাজের সূত্রে আমরা এখন এই বিষয়ের অন্তর্নিহিত কারণ সম্পর্কে জানতে পারছি।’