ড. মুহাম্মদ নাছিরউদ্দীন (সোহেল)
মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) ১৯৮৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর রহমতের সময় মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ‘জামানার মোজাদ্দেদ’ তথা সংস্কারকের সুমহান দায়িত্ব লাভ করেন। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসুল (সা.) বলেন, “নিশ্চয়ই মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে এই উম্মতের জন্য এমন এক ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি ধর্মকে সংস্কার করে সজীব ও সতেজ করবেন।” (আবু দাউদ শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৬)
মহান রাব্বুল আলামিন এই শতাব্দীতে মহান সংস্কারক হিসেবে সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুর কেব্লাজানকে প্রেরণ করেছেন। জগৎশ্রেষ্ঠ এই মহামানব স্বধর্মীদের অজ্ঞতা ও বিধর্মীদের চক্রান্তের ফলে মোহাম্মদী ইসলামে প্রবিষ্ট কুসংস্কারগুলো সংস্কার সাধন করে বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.)-এর চিরশান্তির ধর্ম মোহাম্মদী ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ ও দর্শন মানবজাতির নিকট তুলে ধরেছেন। তাঁর ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারগুলো দেশ ও বিদেশে বিপুল প্রশংসিত হয়েছে এবং তাঁর অনেক সংস্কার বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছে। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের শতাধিক ধর্মীয় সংস্কারের মধ্যে অন্যতম হলো- যে দেশে যে মাতৃভাষা, সেই ভাষায় জুমার খুৎবা দেওয়ার রীতি প্রচলন করার প্রস্তাব উত্থাপন এবং আমাদের বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় খুৎবা প্রদানের প্রচলনের রীতি বাস্তবায়ন।
সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের উল্লিখিত সংস্কারটি আলোচনার পূর্বে পাঠকদের উদ্দেশে নিম্নে খুৎবা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হলো-
খুৎবা কী?
খুৎবা আরবি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ হলো ভাষণ, বক্তৃতা, উপদেশ, প্রস্তাবনা, ঘোষণা, সম্বোধন, ওয়াজ ইত্যাদি। খুৎবা হলো জুমার নামাজের আগে, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার নামাজের পরে, পবিত্র হজে আরাফার দিনে, বিয়ের অনুষ্ঠানে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খলিফার প্রতিনিধি, দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা ইমাম ও খতিব কর্তৃক প্রাসঙ্গিক বক্তৃতা বা ভাষণ। জুমার খুৎবা নামাজের আগে এবং ঈদের খুৎবা নামাজের পরে দেওয়া হয়।
খুৎবার প্রচলন
রাহ্মাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মসজিদ ‘মসজিদে কুবা’-তে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করা হয়। এতে হযরত রাসুল (সা.) নিজেই ইমামতি করেন। সেদিন জুমার নামাজের আগে আল্লাহ্র রাসুল (সা.) দুটি খুৎবা প্রদান করেন। তখন থেকেই শুক্রবারে জুমার নামাজের জামাতের আগে দুটি খুৎবা প্রদানের প্রথা প্রচলিত হয়। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, “নবি করিম (সা.) জুমার নামাজের আগে দুটি খুৎবা দিতেন। একটা শেষ করে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বসতেন, তারপর দ্বিতীয় অংশটি দিতেন। খুৎবার মাঝে তিনি পবিত্র কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করে মানুষকে উপদেশ দিয়ে বোঝাতেন।” (মুসলিম শরীফ, কিতাবুল জুমা)
‘খুৎবা’ জুমার নামাজের শর্ত বা ফরজ। খুৎবা ব্যতীত জুমার নামাজ হয় না। উপস্থিত মুসল্লিদের জন্য খুৎবা শ্রবণ করা ওয়াজিব। তাই খুৎবা চলাকালে নিরর্থক কথা ও কর্মে মশগুল থাকা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “জুমার দিন খুৎবা প্রদানের সময় যদি তুমি তোমার সঙ্গীকে বলো, ‘চুপ করো,’ তখন তুমি অনর্থক কথাই বললে।” (বোখারি শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৭ ও ১২৮)
অন্য এক হাদিসে বর্ণিত আছে, “যখন ইমাম খুৎবার জন্য বের হবেন, তখন নামাজ পড়বে না, কথাও বলবে না।” (মেশকাত শরীফ, ৩/৪৩২)
খুৎবার গুরুত্ব
হযরত রাসুল (সা.) জুমার নামাজে খুৎবা দেওয়ার কারণে জুমার নামাজ অধিক গুরুত্ব লাভ করেছে। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) জুমার খুৎবায় সাহাবিদের উদ্দেশে মহামূল্যবান বাণী মোবারক পেশ করতেন। তাঁর বাণী মোবারকে সঠিকভাবে ধর্ম পালনের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা থাকত। সাহাবায়ে কেরাম পরবর্তী শুক্রবার আসার পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর নসিহত অনুযায়ী সপ্তাহের বাকী ৬টি দিন অতিবাহিত করতেন। তাই শুক্রবারে জুমার নামাজের গুরুত্ব অত্যধিক। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “যারা স্বেচ্ছায় জুমার নামাজ পরিত্যাগ করবে, তাদের অন্তর রুক্ষ হয়ে যাবে এবং তারা মোনাফেক ও কপট বিশ্বাসীদের অন্তর্ভূক্ত হবে।”
হযরত রাসুল (সা.)-এর যুগে জুমার নামাজে অংশগ্রহণ করে সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর সহবত লাভ করতেন এবং তাঁর বরকতময় নসিহত শ্রবণ করে হৃদয়ে অফুরন্ত ফায়েজ পেতেন। এর ফলে তাঁদের মাঝে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন হতো। সেই যুগে সঠিকভাবে ধর্ম পালনের জন্য মনোযোগ দিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর খুৎবা শোনা এবং তদ্নুযায়ী আমল করা সাহাবায়ে কেরাম সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতেন। উল্লেখ্য, একদা হযরত রাসুল (সা.) জুমার নামাজের খুৎবা দিচ্ছিলেন। সেসময় একদল বণিক খাদ্যশস্য নিয়ে মদীনায় আগমন করল। এই সংবাদ জানতে পেরে বহু মুসুল্লি খুৎবা শোনা ছেড়ে শস্য কিনতে চলে যায়। মাত্র ১০ জন মুসুল্লি আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর খুৎবা শোনার জন্য মসজিদেই ছিলেন। (মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, অনুবাদক মাওলানা নূরুর রহমান, এমদাদীয়া লাইব্রেরী, ঢাকা) এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন, “যখন তারা কোনো ব্যবসায়ের কিংবা কোনো ক্রীড়া কৌতুকের বস্তু দেখে আপনাকে খুৎবারত রেখে ওরা সেদিকে ছুটে যায়। আপনি বলে দিন- আল্লাহ্ র কাছে যা আছে, তা ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যবসায়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর।” (সূরা জুমা ৬২: আয়াত ১১)
পবিত্র কুরআনের এই আয়াতের মাধ্যমে খুৎবার গুরুত্ব যে অপরিসীম, মহান আল্লাহ্ তা প্রকাশ করেছেন।
মাতৃভাষায় জুমার খুৎবা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা
সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুর কেব্লাজান সর্বপ্রথম মাতৃভাষায় খুৎবা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তাঁর যৌক্তিক উপস্থাপনের ফলে বাংলাদেশের বহু মসজিদে এখন আরবি ভাষার পাশাপাশি বাংলায় খুৎবা দেওয়া চালু হয়েছে। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান বলেন, “নানা পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে মুসলমানদের কর্তব্য ও করণীয় বিষয়ক প্রয়োজনীয় সময়োপযোগী উপদেশ প্রদানের উদ্দেশে শুক্রবার জোহর ওয়াক্তের ৪ রাকাত নামাজের পরিবর্তে ২ রাকাত নামাজ ও অবশিষ্ট ২ রাকাতের পরিবর্তে খুৎবার বিধান রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে খুৎবা প্রদান আরবি ভাষায় হওয়ায় মুসল্লিগণ খুৎবার বিষয়বস্তু বুঝতে পারেন না। ফলে আমল করে তা থেকে উপকৃত হতে পারেন না।”
হযরত রাসুল (সা.) আরব দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন বিধায় তিনি আরবি ভাষায় খুৎবা প্রদান করতেন। কেননা আরবদের ভাষা আরবি। ফলে আল্লাহ্ র রাসুল (সা.)-এর খুৎবা সাহাবায়ে কেরামের বুঝতে কোনো অসুবিধা হতো না। এছাড়া হযরত রাসুল (সা.) আরবি ভাষাভাষী হওয়ায় মহাগ্রন্থ আল কুরআন আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ আরবদের লক্ষ্য করে বলেন, “আমি কুরআনকে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছি, যেন তোমরা সহজে তা বুঝতে পারো।” (সূরা ইউনুস ১২: আয়াত ২)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পৃথিবীতে যত ভাষা রয়েছে সকল ভাষাই আল্লাহ্র। ৪টি প্রধান আসমানি কিতাবের প্রত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় মহান আল্লাহ্ নাজিল করেছেন। হযরত মুসা (আ.)-এর উপর অবতীর্ণ ‘তাওরাত’ নাজিল হয়েছে হিব্রু বা ইবরানি ভাষায়; হযরত দাউদ (আ.)-এর উপর অবতীর্ণ ‘জাবুর’ কিতাব নাজিল হয়েছে ইউনানি বা আরমাইক ভাষায় এবং হযরত ঈসা (আ.)-এর উপর অবতীর্ণ ‘ইনজিল’ কিতাব নাজিল হয়েছে সুরইয়ানি ভাষায়। এর মাধ্যমে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ্ তায়ালা যে জাতি বা সম্প্রদায়ের জন্য রাসুলগণকে প্রেরণ করেছেন, সেই জাতি বা সম্প্রদায়ের ভাষা অনুসারে আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন, যেন প্রতিটি সম্প্রদায় আল্লাহ্র বাণী সঠিকভাবে বুঝতে পারে। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- মহান আল্লাহ্ বলেন, “আমি প্রত্যেক রাসুলকে তাঁর স্বজাতির ভাষা-ভাষী করে প্রেরণ করেছি, যেন সে (আমার বাণী) তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করতে পারে।” (সূরা ইব্রাহিম ১৪: আয়াত ৪)
সুতরাং সুস্পষ্ট যে, মহান আল্লাহ্ র বাণী বোঝার জন্য ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। হযরত রাসুল (সা.) আমাদের বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেননি, তিনি আরবে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাই আমাদের মুসলমানরা মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত রাসুল (সা.)-এর আদেশ, নিষেধ, উপদেশ মাতৃভাষা বাংলায় জানতে পারলে, সেগুলো তাদের জন্য বোধগম্য বেশি হবে।
বাংলা ভাষায় জুমার খুৎবা প্রচলনের বিষয়টি উপস্থাপনপূর্বক মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুর কেব্লাজান বলেন, “আমাদের দেশে জুমার নামাজ ও খুৎবার প্রচলন রয়েছে বটে, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও মর্মার্থ বাস্তবে উপলব্ধি করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ দেশের মসজিদসমূহের খতিবগণ সাধারণত বারো চান্দের খুৎবার কিতাব সংগ্রহ করে তা দেখে দেখে আরবি ভাষায় অনর্গল খুৎবা পাঠ করেন। এতে মুসুিল্লরা খুৎবার মধ্যস্থিত কথাগুলো আদৌ বুঝতে পারলো কি-না, সেই বিষয়ে তারা কোনো খেয়াল রাখেন না। অথচ আমাদের দেশের প্রায় সবাই আরবি ভাষার অর্থ না জানার কারণে খতিবের দেওয়া খুৎবা শ্রবণ করেন, কিন্তু তা থেকে কোনো কিছুই হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন না। ফলে মুসুল্লিরা এরকম খুৎবা হতে কোনো প্রকার উপকার লাভ করেন না- যা খুৎবা পাঠের মুখ্য উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। বাংলা ভাষায় খুৎবা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা বহুবিধ। প্রথমত আমাদের এ দেশের মানুষের ভাষা বাংলা। তাছাড়া শিক্ষার দিক থেকেও আমরা ততটা অগ্রসর না হওয়ায় আরবি ভাষার অর্থ জানে এমন লোকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। ফলে আরবি ভাষায় খুৎবা দেওয়া হলে মুসুল্লিরা তা থেকে কোনো কিছুই শিখতে পারেন না। তাই সবার বোধগম্য হওয়ার জন্য বাংলা ভাষায় খুৎবা প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। যেহেতু খুৎবায় পবিত্র কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতি থাকে, সেহেতু মুসুল্লিরা নিয়মিতভাবে খুৎবা শ্রবণ করলে ধর্মীয় বিষয়াদি সম্পর্কে প্রভূত জ্ঞান লাভ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে প্রতি জুমার খুৎবা হতে কিছু কিছু শিক্ষা লাভ করত মুসুল্লিরা ধর্মীয় অনেক বিষয় সম্পর্কে অবগত হতে পারেন। এতে ক্রমান¦য়ে সমাজের মানুষের মাঝে ধর্মীয় জ্ঞানের প্রসার ঘটবে। দ্বিতীয়ত আরবি বিদেশি ভাষা হওয়াতে আমাদের দেশের ইমামগণের অধিকাংশই এ ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারেন না। এজন্যে আরবিতে তাঁরা সময়োপযোগী খুৎবা দিতে ব্যর্থ হন। ফলে তাঁরা প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে একই খুৎবা পাঠ করেন, যা খুৎবার প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। খুৎবা বাংলায় হলে এক দিকে খতিবগণের সময়োপযোগী খুৎবা দেওয়া সহজ হবে এবং অপরদিকে মুসুল্লিরাও তা থেকে ধর্মীয় ও সামাজিক দিকনির্দেশনা লাভ করতে সক্ষম হবেন। (সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী ধর্মীয় সংস্কার, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৫)
সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান আরও বলেন, “লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক রেখে বাংলা ভাষায় খুৎবা প্রদান করা উত্তম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইমামে আজম হযরত আবু হানিফা (রহ.) নামাজের ক্বিরাত ফারসি ভাষায় পড়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। ‘নূরুল আনওয়ার’ কিতাবে আছে, ‘আবি হানিফাতা রাহ্মাতুল্লাহি ‘আলাইহি লিল ক্বিরাতিল ফারছিয়্যাতি ফিস্ সালাতি মা‘আল ক্বুদরাতিন নাজ্বমিল আরবি।’ ভাবার্থ ‘হযরত আবু হানিফা (রহ.) নামাজের মধ্যে ফারসি ভাষায় ক্বিরাত পড়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন, যদিও আরবি ভাষায় উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়।’ ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর উপরোক্ত মতের দিকে লক্ষ্য করলে একথা বলা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না যে, নামাজ পড়া হয় আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে, আর সেই নামাজের একাগ্রতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থ বোঝানোর জন্যে ক্বিরাত যদি ফারসি বা অন্য কোনো ভাষায় পড়া যায়, তাহলে মুসুল্লিদের উদ্দেশ্যে খুৎবা বা বক্তৃতা আমাদের দেশে বাংলা ভাষায় দেওয়া যাবে না কেন? এ প্রসঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ’-এর ‘খুৎবার’ বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, ‘ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কোনো কোনো মসজিদে খুৎবায় স্থানীয় ভাষা ব্যবহৃত হয়’।” (সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী ধর্মীয় সংস্কার, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৬-৭৭)
সুতরাং যে দেশে যে ভাষা, সেই ভাষায় খুৎবা দেওয়া নিঃসন্দেহে উত্তম ও অত্যাবশ্যক। কেননা বর্তমানে হযরত রাসুল (সা.)-এর মোহাম্মদী ইসলাম শুধু আরবেই সীমাবদ্ধ নয়। ইসলাম এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। মুসলমানদের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু ইসলামের মূল আরবি ভাষা থেকে উদ্ভূত, তাই বিভিন্ন ভাষায় যদি একে যথাযথভাবে রূপান্তর করা হয়, তাহলে মোহাম্মদী ইসলামের সর্বজনীনতা আরো বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মানুষেরা পবিত্র কুরআন ও হাদিসের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারবে এবং সেই অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করতে সক্ষম হবে।
উল্লেখ্য, যে কোনো বিষয় সম্পর্কে যদি সঠিকভাবে জ্ঞানার্জন করতে হয়, সেই বিষয়টি যে ভাষায় রচিত সেই ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে, অথবা সেই বিষয়টি মাতৃভাষায় অনূদিত হতে হবে। আরবি যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা নয়, তাই ইসলামি শরিয়তের বিধি-বিধানসমূহ বাংলা ভাষায় সঠিকভাবে অনূদিত হলে সর্বস্তরের মানুষের জন্য তা সহজ ও বোধগম্য হবে এবং বাস্তবভিত্তিক অনুশীলন ও চর্চায় মনোযোগ বা আকর্ষণ বৃদ্ধি পাবে। জু’মার খুৎবায় আরবির পাশাপাশি বাংলা ভাষায় প্রদান করা হলে মুসল্লিদের খুৎবা শোনার প্রতি মনোযোগ বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুর কেব্লাজানের কদম মোবারকে লাখো শুকরিয়া, তিনি দয়া করে মাতৃভাষা বাংলায় খুৎবা প্রদানের রীতি প্রচলন করে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের খুৎবা বুঝার সুযোগ করে দিয়ে তদ্নুযায়ী আমল করার পথকে সহজ করে দিয়েছেন।
পরিশেষে- আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে স্মরণ করছি, জগৎশ্রেষ্ঠ এই মহামানব ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। তাঁর প্রচারিত মোহাম্মদী ইসলাম আজ বিশ্বের শতাধিক দেশে প্রচার হচ্ছে এবং সেই দেশগুলোতে বাংলা ভাষাও প্রচার হচ্ছে। এই বাংলা ভাষার জন্য ১৯৫২ সালের এই ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে বাংলা মায়ের সূর্য সন্তানরা তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাই সকল শহিদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।