মোহাম্মদী ইসলামের পরিচয়

মোহাম্মদী ইসলামের পরিচয়

মোহাম্মদী ইসলাম শব্দটি ‘মোহাম্মদী’ ও ‘ইসলাম’- এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। মোহাম্মদ হলো হযরত রাসুল (সা.)-এর পবিত্র নাম মোবারক, আর আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি যে পরিপূর্ণ ধর্ম দিয়েছেন, সেটি হলো ইসলাম। সুতরাং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব কুল কায়নাতের রহমত সরওয়ারে কায়েনাত, মুফাখখারে মওজুদাত হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা, আহমদ মোজতবা (সা.) মানব জাতির মুক্তির জন্য যে ধর্ম প্রবর্তন করেছেন, তাই হলো মোহাম্মদী ইসলাম।
আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “বুনিইয়াল ইসলামু ‘আলা খামসিন শাহাদাতি আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান ’আবদুহূ ওয়া রাসূলুহূ ওয়া ইক্বামিস সালাতি ওয়া ঈতাইঝ ঝাকাতি ওয়াল হাজ্জি ওয়া সাওমি রামাদ্বান।” অর্থাৎ- “ইসলামের স্তম্ভ হলো পাঁচটি বিষয়ের উপর (১) আল্লাহ্ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহ্ র বান্দা ও রাসুল-এ সাক্ষ্য প্রদান করা। (২) সালাত কায়েম করা। (৩) যাকাত দেওয়া। (৪) হজ করা এবং (৫) রমজান এর রোজা পালন করা।’ (বোখারী ও মুসলিম শরীফের সূত্রে মিশকাত শরীফ পৃষ্ঠা ১২)
হযরত মোহাম্মদ (সা.) কর্তৃক এ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মই হলো মোহাম্মদী ইসলাম। মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন- “ইন্নাদ দ্বীনা ইনদাল্লাহিল ইসলাম।” অর্থাৎ- নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহ্র নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম। (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ১৯) তাই দেখা যায়, হযরত আদম (আ.) থেকে আখেরি নবি হযরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সমস্ত নবি-রাসুল ইসলামের চিরন্তন বাণী প্রচার করেছেন। এ কারণে সূফীদের বর্ণনা থেকে জানা যায় হযরত আদম (আ.)-এর উম্মতের কালেমা ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আদামু শফিউল্লাহ।’ হযরত নূহ (আ.)-এর উম্মতের কালেমা ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু নূহু নাবিয়্যুল্লাহ।’ হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর উম্মতের কালেমা ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ইব্রাহীমু খালীলুল্লাহ।’ হযরত মুসা (আ.)-এর উম্মতের কলেমা ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মূসা কালীমুল্লাহ।’ হযরত ঈসা (আ.)-এর উম্মতের কালেমা ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ঈসা রুহুল্লাহ।’ আর আখেরি নবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের কালেমা হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’
সুতরাং সমস্ত নবি ও রাসুলের উম্মতই তাদের কালেমাতে প্রথমত তাওহিদের স্বীকারোক্তি প্রদান করেছেন এবং পরবর্তীতে তারা স্বীয় নবির প্রতি অনুগত্যের সাক্ষ্য হিসাবে সেই নবির নাম উল্লেখ করেছেন। আর ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা আল মায়িদাহ ৫: আয়াত ৩)
আমরা জানি, হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত আল্লাহ্র মনোনীত নবি রাসুলগণের প্রবর্তিত ধর্মই ছিল ইসলাম। সমস্ত নবি রাসুলের ধর্মের মারেফাতের দিক অভিন্ন থাকলেও তাঁরা প্রত্যেকেই আল্লাহ্ রসাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সমকালীন যুগের মানুষের জন্য সময়োপযোগী শরিয়তের বিধিবিধান প্রবর্তন করেছেন। অনুরূপভাবে আখেরি নবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-ও মানবজাতির জন্য যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানসম্মত জীবন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এর নামকরণ করেছেন ‘দ্বিনে মোহাম্মদী’ বা মোহাম্মদী ধর্ম তথা মোহাম্মদী ইসলাম।
এ প্রসঙ্গে তাফসীরে মাআরেফুল কুরআনে উল্লেখ রয়েছে, “জগতে পয়গম্বরগণ যত ধর্ম এনেছেন, নিজ নিজ সময়ে সে সবই আল্লাহ্র কাছে মকবুল (গৃহীত) ছিল। সুতরাং নিঃসন্দেহে সেসব ধর্ম ছিল ইসলাম। যদিও সেগুলো বিভিন্ন নামে অভিহিত হতো। যেমন হযরত মুসা (আ.)-এর ধর্ম, হযরত ঈসা (আ.)-এর ধর্ম, তথা ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্টান ধর্ম ইত্যাদি। কিন্তু সবগুলোর স্বরূপ ছিল ইসলাম, যার মর্ম আল্লাহ্র অনুগত্য। তবে এ ব্যাপারে ইবরাহিমি ধর্মের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি নিজ ধর্মের নাম ‘ইসলাম’ রেখেছিলেন এবং স্বীয় উম্মতকে ‘উম্মতে মুসলিমাহ’ নামে অভিহিত করেছিলেন।” (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, পৃষ্ঠা ৬৭) পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ (মিল্লাতা ইবরাহীম) দিয়ে ইবরাহিমের ধর্ম বুঝিয়েছেন। ধর্মের কথা বলতে গিয়ে ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং আরবের মুশরিকরাও বলে যে, তারা ইবরাহিমি ধর্মের অনুসারী, কিন্তু এসব তাদের ভুল ধারণা অথবা মিথ্যা দাবি মাত্র। বাস্তবে মোহাম্মদী ধর্মই শেষ জমানায় ইবরাহিমি ধর্ম তথা স্বভাব ধর্মের অনুরূপ। (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, পৃষ্ঠা ৬৮)
একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ইবরাহিমি ধর্ম, মুসায়ি ধর্ম, ঈসায়ি ধর্ম কিংবা এর পূর্বে নবিদের পালিত ধর্মের মূলে ইসলাম। কিন্তু এক এক নবির শরিয়ত ভিন্ন হওয়ায় ইবরাহিমি ধর্ম, মুসায়ি ধর্ম, ঈসায়ি ধর্ম বলা হয়। তবে তাদের শরিয়ত তাদের যুগের জন্য প্রযোজ্য। আর মোহাম্মদী ধর্ম বা মোহাম্মদী ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ইসলাম, যা বিদায় হজের দিবসে পূর্ণতা পেয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ মোহাম্মদী ইসলামের শরিয়ত বলবৎ থাকবে। এমনিভাবে “একদা ইবনুল কাওয়া হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহুর নিকট সুন্নত, বিদআত, জামাত এবং মতভেদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু বললেন, হে ইবনুল কাওয়া, তোমার প্রশ্ন আমি বুঝেছি, তুমি জবাব বুঝে নাও। আল্লাহ্র শপথ সুন্নত হচ্ছে মোহাম্মদী তরিকা (মোহাম্মদী ইসলাম)। আর বিদআত হচ্ছে সুন্নতকে পরিত্যাগ করা।” (নিউ দারুল কিতাব প্রকাশিত, হায়াতুস সাহাবা দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৭)।
উক্ত ঘটনায় হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহুর উক্তি মোহাম্মদী তরিকা শব্দ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ মোহাম্মদী ইসলামকেই বুঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হযরত মোহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ওহির বাণী আল কুরআন লাভ করেছেন এবং শরিয়তের বিধি বিধান নিয়ে এসেছেন। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আনিত এ শরিয়তকে মোহামেডান ল’ বা মোহাম্মদী আইন বলা হয়। কিন্তু উমাইয়াদের শাসনামল থেকে যখন ইসলামি খেলাফতের নাম পরিবর্তন করে উমাইয়া শাসন হিসেবে আখ্যায়িত করা হলো, তখন থেকে সুকৌশলে ইসলাম শব্দের সাথে যে ‘মোহাম্মদ’ শব্দটি ছিল তা বাদ দেওয়া হয়। এভাবে মুসলমানদের কৌশল করে হযরত মোহাম্মদ (সা.) থেকে বিচ্ছিন্ন করে সমগ্র মুসলিম জাতিকে কাণ্ডারিবিহীন করে ফেলা হয়েছে। তাই আজ আমরা আমাদের প্রিয় নবি (সা.)-এর নাম সংবলিত মোহাম্মদী ইসলামের কথা শুনলে চমকে উঠি। অথচ দুনিয়াতে যত ধর্ম, যত মতবাদ, যত আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, তার প্রায় সবই স্ব স্ব ধর্ম, মতবাদ ও আদর্শের প্রবর্তকদের নাম অনুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন মাজহাব ও তরিকাগুলো এসব মাজহাবের ও তরিকার ইমামগণের নামের অনুসরণ করে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর নামানুসারে হানাফি মাজহাব, ইমাম শাফি (রহ.)-এর নামানুসারে শাফেয়ি মাজহাব, ইমাম মালেক (রহ.)-এর নামানুসারে মালেকি মাজহাব, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর নামানুসারে হাম্বলি মাজহাব। অনুরূপভাবে গাউসে পাক আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর নামানুসারে কাদেরিয়া তরিকা, গরিবে নেওয়াজ হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর নামানুসারে চিশতিয়া তরিকা, খাজা বাহাউদ্দিন নকশাবন্দ (রহ.)-এর নামানুসারে নকশবন্দিয়া তরিকা, হযরত শায়খ আহমদ মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রহ.)-এর নামানুসারে মোজাদ্দেদিয়া তরিকা, ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর নামানুসারে সুলতানিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরিকা। অনুরূপভাবে যারা পবিত্র কুরআনের তাফসীর করেছেন তাঁদের স্বনামে তাফসীর গ্রন্থগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। যেমন তাফসীরে ইবনে আব্বাস, তাফসীরে ইবনে কাছীর, তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে কাদেরী, তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী ইত্যাদি। অন্যদিকে যারা হযরত রাসুল (সা.)-এর হাদিস সংগ্রহ করে সংকলন করেছেন, তাঁদের স্বনামে হাদিস গ্রন্থসমূহের নামকরণ করা হয়েছে। যেমন- বোখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, তিরমিযী শরীফ ইত্যাদি।
হযরত রাসুল (সা.) মানবজাতির মুক্তির জন্য এলমে শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফাত সংবলিত পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে মোহাম্মদী ইসলামের পরিপূর্ণ জীবন বিধান আল কুরআন প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি সেই অনুযায়ীই মানুষকে পরিচালনা করেছেন। সুতরাং মোহাম্মদী ইসলাম নতুন কোনো বিষয় নয়। এটা হলো হযরত রাসুল (সা.) প্রবর্তিত আল্লাহ্ রমনোনীত ধর্ম ইসলাম। হযরত রাসুল (সা.) যেহেতু দীর্ঘ ১৫ বছর মোরাকাবা করে মহান আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ করেছেন এবং পরবর্তী ২৩ বছর পূর্ণাঙ্গ মোহাম্মদী ইসলাম মানবজাতিকে উপহার দিয়েছেন, তাই মহান আল্লাহ্ এ ধর্মকে হযরত রাসুল (সা.)-এর ধর্ম বলে সম্বোধন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন -“[হে মোহাম্মদ (সা.)] আপনি বলুন, হে মানব জাতি! তোমরা যদি আমার ধর্মের ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে থাকো, তবে জেনে রেখ আমি তাদের ইবাদত করি না, যাদের ইবাদত তোমরা করো আল্লাহ্কে ছেড়ে। বরং আমি ইবাদত করি আল্লাহ্র যিনি তোমাদের মৃত্যু দেন। (সূরা ইউনুস ১০: আয়াত ১০৪)
উল্লিখিত আয়াতে ‘দ্বীনী’ শব্দের অর্থ হলো আমার ধর্ম অর্থাৎ মোহাম্মদ (সা.)-এর ধর্ম। আর এটি হলো মোহাম্মদী ইসলাম। এমনিভাবে কবরে লাশ রাখার সময় যে দোয়া পাঠ করা হয় তাতেও প্রমাণিত হয় আমাদের ধর্মের নাম মোহাম্মদী ইসলাম। আল্লাহ্ র রাসুল (সা.) যখন কবরে লাশ রাখতেন, তখন তিনি বলতেন- “বিসমিল্লাহি ওয়া ‘আলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ।” অর্থাৎ- মহান আল্লাহ্র নামে এবং তাঁর রাসুলের ধর্মের উপর (তোমাকে) রাখা হলো। (সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা ১১১)
সুতরাং মোহাম্মদী ইসলাম বলতে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রচারিত পূর্ণাঙ্গ ইসলামকেই বুঝায়। ‘মোহাম্মদ’ তো অন্য কারো নাম নয়। যিনি পরিপূর্ণ ইসলামি শরিয়তের বিধান আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ করে এনেছেন তাঁর নামেই মোহাম্মদী ইসলাম হওয়াই যথার্থ ও যুক্তিযুক্ত। কেননা তাঁকে বিশ্বাস করে তাঁর নাম সংবলিত কালেমা- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” পাঠ করে মুসলমান হতে হয়। সুতরাং আল্লাহ্ প্রদত্ত হযরত মোহাম্মদ (সা.) কর্তৃক প্রচারিত পরিপূর্ণ ধর্মের নামই হলো মোহাম্মদী ইসলাম।
ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর রচিত ‘মোহাম্মদী ইসলামের তালিম’ নামক কিতাব থেকে সংকলিত
সংকলনে- ড. আরিফ হোসেন

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *