বগুড়া সংবাদদাতা: একসময় বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হতো নানারকম কৃষি যন্ত্রপাতি। এখন রপ্তানি করছে বাংলাদেশ নিজেই। বগুড়ায় তৈরি সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প, টিউবওয়েল, পানির পাম্প, ধান মাড়াইয়ের যন্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান প্রভৃতি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বগুড়ার প্রায় পাঁচ লাখ লোকের ভাগ্য বদলে দেওয়া কৃষি ও হালকা প্রকৌশলশিল্পের বার্ষিক আয় প্রায় হাজার কোটি টাকা।
যেসব উদ্যোক্তা এই খাতকে ছোট্ট পরিসর থেকে মহিরুহ করেছেন তেমনই একজন সফল উদ্যোক্তা কামাল মিয়া। তিনি বগুড়া শহরতলির কামাল মেশিন টুলসের স্বত্বাধিকারী। ছোট্ট কারখানা থেকে এখন কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরির পাশাপাশি কৃষি যন্ত্রাংশ গবেষণা কাজেও যুক্ত হয়েছেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে লাভ করেছে আইএসও সনদ; পেয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক’।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বগুড়া শহরের গোহাইল রোডে ‘শাজাহান ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ নামের প্রতিষ্ঠানে ৭০ টাকা সপ্তাহের মজুরিতে কাজ শুরু করেন কামাল মিয়া। সেখানেই বিভিন্ন কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং গ্রামগঞ্জ ঘুরে কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামতের কাজ করতে থাকেন। তাঁর দক্ষতার কথা শুনে সে সময় উত্তরবঙ্গ গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজে নিয়োজিত কেডিসি নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাঁকে কাজে ডেকে নেয়। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি সেই প্রতিষ্ঠানে নলকূপ স্থাপনের কাজ করতে গিয়ে কৃষিকাজে যান্ত্রিকীকরণ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন।
এরপর কেডিসি ছেড়ে দিয়ে বগুড়া শহরে একজন উদ্যোক্তাকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং নামের প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান গড়তে গিয়ে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে তাঁকে একটি লেদ মেশিন কিনতে হয়। সেই টাকা জোগাড় করতে প্রথম ঋণ করেন তিনি। ব্যক্তি পর্যায় থেকে নেওয়া সেই ঋণ পরিশোধ করতে না করতেই অংশীদারের সঙ্গে কিছুটা মনোমালিন্য দেখা দেয়। এরপর ১৯৮৬ সালে নিজ বাড়ির সন্নিকটে গড়ে তোলেন কামাল মেশিন টুলস (কেএমটি) নামের প্রতিষ্ঠান।
এ সময় দেশে চাষযন্ত্র হিসেবে পওয়ার টিলার আমদানি শুরু হয়। পাশাপাশি পাওয়ার টিলার ও ডিজেল ইঞ্জিনের বিভিন্ন মেশিন ছিল। এসব মেশিনের খুচরা যন্ত্রাংশ সহজলভ্য না হওয়ায় তিনি তা তৈরি শুরু করেন। এরই মধ্যে সরকারিভাবে বগুড়ায় ধোলাইখাল মডেল নামের একটি প্রকল্প শুরু হয়। এই প্রকল্পটি বগুড়ার কৃষি ও হালকা প্রকৌশলশিল্পের গতিই বদলে দেয়। একের পর এক উদ্যোক্তা এসে যুক্ত হন কৃষি ও হালকা প্রকৌশলশিল্পে। তিনি নিজে ধোলাইখাল মডেল প্রকল্প থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নেন। কিন্তু সরকারি এই উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকেও এই খাতে ঋণ দেওয়া শুরু হলে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পণ্য উৎপাদন শুরু হয়। এতে করে ঋণ পরিশোধ নিয়ে জটিলতায় পড়েন অনেকে। ফলে অনেক উদোক্তা সে সময় ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু তিনি চালিয়ে গেছেন তাঁর কাজ। একের পর এক তিনি ধান, গম, সরিষা ও ডাল, ভুট্টা মাড়াই মেশিন, বীজ বপন যন্ত্র তৈরি করেন। তাঁর তৈরি করা যন্ত্র বাজারে ব্যাপক সাড়া ফেললে উৎপাদনে আর্থিক সংস্থান করতে তিনি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৪৫ লাখ টাকা ঋণ নেন। এরপর তিনি আর ঋণমুখী হননি। কামাল মিয়া জানান, কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরিতে তাঁর সাফল্যের কারণে বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ), ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর প্রতিষ্ঠানকে কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি এবং গবেষণায় যুক্ত করে। তিনি এখন এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশ উদ্ভাবনে গবেষণা কাজ করছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান কেএমটিতে কাজ শেখার পর এখন বগুড়ার অন্তত ১০ জন উদ্যোক্তা নিজের প্রতিষ্ঠান দিয়ে কৃষি ও হালকা প্রকৌশলশিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।