কুলসুম রশীদ: “হে রাসুল আপনি যদি না হতেন, তাহলে আমি আকাশ ও ভ‚মণ্ডল সৃষ্টি করতাম না।” (হাদিসে কুদসি) পৃথিবীতে শান্তির বাণী শোনানোর জন্য শান্তিদাতা আহমদ মোজতবা মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে এ ধরাধামে আগমন করেছিলেন।
দিনটিকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করে থাকেন ঈদের মতো। কারণ এই ঈদ না এলে বাকি দুই ঈদ কোথা থেকে আসত? কে জানত যে আমাদের ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার কথা। তাই মিলাদুন্নবি (সা.) উদযাপনে আমরা যেন কার্পণ্যতা না করি। যুগে যুগে নবি রাসুল এসে আল্লাহর বাণী শুনিয়েছেন, কিন্তু তাতে পরিপূর্ণতা আসেনি। অতঃপর হুজুর পাক (সা.) তাশরিফ নিয়ে এসেছিলেন।
জন্মের সময় মা আমেনা একটি আলো দেখতে পান এবং তাঁর ভ‚মিষ্ঠ হওয়ার সময় এমন একটি আলো বের হতে দেখেন যা শামের প্রাসাদগুলোর উজ্জ্বলতাকে নিষ্প্রভ করে দিয়েছিল। (মোওয়াহিবুদ্দুনিয়া ১/১২) অবশ্যই তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো (নুর) ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে। (সূরা মায়িদা, আয়াত ১৫) এখানে নুর দ্বারা উদ্দেশ্য মোহাম্মাদ (সা.) আর কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কুরআন। (তাফসিরে কাবির, মাজহারি, ইবনে কাসির, জালালাইন, কুরতুবি) হযরত রাসূল (সা.)-এর ছায়া কখনো জমিনে পড়েনি। চন্দ্র সূর্যের আলোতেও তার প্রতিচ্ছবি কখনো দেখা যায়নি। ইবনে সাবা বলেন কেননা তিনি নিজেই ছিলেন একটি নুর। (ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে খাছায়েসুল হাবিবে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, লোকেরা প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার নবুয়ত কখন অবধারিত হয়েছে? তিনি বলেন: যখন আদম (আ.) তার শরীর ও রুহের মধ্যে ছিল। (তিরমিজি, মেশকাত) আমি আদমকে যদিও সফিউল্লাহ (নবি হিসাবে নির্বাচন করে) বানিয়েছি, কিন্তু নবুয়তের ধারা আপনার দ্বারা সমাপ্ত করেছি, আর আমি আপনার চেয়ে অধিক প্রিয় কোনো জীব সৃষ্টি করিনি। (হাদিসে কুদসি)
হযরত রাসুল (সা.) বলেন, আমি যথাক্রমে পূতঃপবিত্র পুরুষের পিঠ থেকে পূতঃপবিত্র নারীদের রেহেমে স্থানান্তর হয়ে এসেছি; উপরন্ত হযরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) পর্যন্ত তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ কাফের ছিল না। (নেয়ামতে কুবরা)
দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিব (আ.) পুরো আরবের সবাইকে নিয়ে জন্মোৎসব করেছিলেন। তার থেকে এ আনন্দ থেমে নেই। কুরআন পাকে উৎসব মানানোর জন্য বলা হয়েছে যে, যখন তোমরা আল্লাহর রহমত পাবে তখন তোমরা আনন্দিত হবে। আর রহমত বলতে তো অন্য কিছু না, রহমত বলতে বুঝিয়েছেন রাহমাতুল্লিল আলামিন। সব পৃথিবীর জন্য যিনি রহমত।
বর্তমানে প্রায় সবাই নিজেদের সন্তানদের জন্মোৎসব পালনে সচেষ্ট অথচ যার জন্য রাব্বুল আলামিন এই বিশ্বচরাচর সৃষ্টি করেছেন তার আগমনের দিনটিকে উদযাপন করতে অনেক রকমের বিদাতের ফতোয়া প্রদান করেন। এ বিষয়ে আমরা সম্মানিত সাহাবা ও আওলিয়া কেরামদের কিছু উক্তি প্রদান করছি। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর জন্মদিনে এক দিরহাম খরচ করবে সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।
হযরত উমর (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনকে সম্মান করবে সে যেন ইসলামকেই জীবিত করল। হযরত ওসমান (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনে এক দিরহাম খরচ করবে সে যেন বদর ও হুনাইন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। হযরত আলী (রা.) বলেন যে ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনকে সম্মান করল এবং তার সিরাত পাঠের অছিলা হলো সে দুনিয়া থেকে ইমানের সঙ্গে যাবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (ইমাম কুসতুল্লানি ও ইবনে হাজার মক্কি থেকে, রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনের ফজিলত সম্পর্কে অধ্যায়)
হযরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন যদি আমার উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকত তাহলে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিনে ব্যয় করতাম। (নেয়ামতে কুবরা) হযরত জুনায়েদ বাগদাদি (রহ)-এর বাণী যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিনের সভায় উপস্থিত হবে এবং এর মর্যাদাকে মূল্যায়ন করবে সে ইমান দ্বারা কামিয়াব হবে। (নেয়ামতে কুবরা)
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন যে ব্যক্তি নবিজি (সা.)-এর জন্মদিবস উপলক্ষ্যে তার ভাইদের একত্র করে খাবারের আয়োজন করবে, তার আলোচনার জন্য একটি স্থান খালি করবে, নেক কাজ করবে এবং তার সিরাত পাঠের অসিলা হবে। এ স্থান (বাড়ি) নানারকম বিপদগুলো থেকে মুক্ত থাকবে। আল্লাহ তায়ালা তাকে পুনরুত্থান দিবসে সিদ্দিকিন, শোহাদা ও সালেহিনদের সঙ্গে ওঠাবেন এবং সে অবস্থান করবে জান্নাতুন নাইমে। (নেয়ামতে কুবরা)
এবার তাঁর নামের বিষয়ে আলোচনায় আসা যাক। আল্লাহর নামের মধ্যে চারটি অক্ষর। মুহাম্মদের নামের মধ্যেও চারটি অক্ষর। আল্লাহ নামের মধ্যেও একটা তাশদিদ, মুহাম্মদের নামের মধ্যে একটা তাশদিদ। আল্লাহর নামের মধ্যে চারটি নাম লুকিয়ে আছে। মুহাম্মদেরও চারটি নাম লুকিয়ে আছে। আল্লাহর চারটি নাম, ‘আল্লাহ’ আলিফ বাদ দিলে ‘লিল্লাহ’ লাম বাদ দিলে ‘লাহু’ ‘হু’ এ চারটি হচ্ছে আল্লাহর নাম। আর মুহাম্মদের মিম দিয়ে ‘মুহিয়্যু’ হা দিয়ে হাইয়্যো, আবার মিম দিয়ে ‘মুমীতু’ আর দাল দিয়ে ‘দায়েমু’। মুহাম্মদের বাংলা অর্থ হলো প্রশংসিত। রাসুল (সা.)-এর নাম শুনলে (সা.) বলা ওয়াজিব, বারবার বলা সুন্নত।
হযরত আবু দারদা (রা.) বলেন, হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সকালে দশবার ও সন্ধ্যায় দশবার আমার ওপর দরুদ পাঠ করবে সে কিয়ামতের দিন আমার শাফায়েত লাভে ধন্য হবে। (তাবরানি)। দরুদ পাঠ ছাড়া নামাজ শুদ্ধ হয় না। কালেমায় আল্লাহ পাকের সঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) নাম জড়িয়ে রয়েছে। হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- কেউ যদি আমার ওপর দরুদ পাঠ করতে চায় সে যেন প্রথম আল্লাহ তায়ালার হামদ ও সানা পাঠ করে তারপর আমার ওপর দরুদ পাঠ করে অতঃপর যা ইচ্ছা দোয়া করে। (জিয়াউল আফহাস, হাফেজ ইবনুল কাইয়িম (রহ) পৃষ্ঠা ২৩) দরুদ শরীফ না পড়লে কোনো দোয়া কবুল হয় না।