মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধির কারণ জলবায়ু পরিবর্তন

মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধির কারণ জলবায়ু পরিবর্তন

অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
জলবায়ুর পরিবর্তন আমাদের পরিবেশের নানামুখী পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি ও প্রসারে ভূমিকা রাখছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ঘনবসতিপূর্ণ নদীমাতৃক দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য আমাদের অবস্থান বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মশাবাহিত ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। ডেঙ্গু একসময় ঢাকাসহ অন্যান্য শহরাঞ্চলে দেখা গেলেও এবার গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। পরিবেশদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। তাপমাত্রা মশার জীবনচক্র এবং আচরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
উষ্ণ তাপমাত্রা মশার বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে পারে। মশার প্যাথোজেনের ইনকিউবেশন সময়কে ছোট করতে পারে এবং মশার কামড় দেওয়ার প্রবণতা বাড়াতে পারে। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা মশার বংশ বৃদ্ধি এবং রোগ সংক্রমণের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বাংলাদেশে ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা প্রায় ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এই উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রবণতা মশার আবাসস্থল বিস্তারে অবদান রেখেছে। যার ফলে মশাবাহিত রোগের ঝুঁকিও বেড়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ের আবহাওয়া মশার উপযোগী হওয়ায় ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। বাতাসের আর্দ্রতা ৬০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে এবং ২০০ থেকে ৮০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত মশার জন্য আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি করে। ১৯৭৬ থেকে ২০২২ সালের আবহাওয়ার তথ্য নির্দেশ করে, ঢাকায় আর্দ্রতার মাত্রা কমছে, তাপমাত্রা বাড়ছে এবং গ্রীষ্মে ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এগুলোর সঙ্গে নগরায়ণের মতো কারণও ঢাকা শহরে ডেঙ্গু বিস্তারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তন জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিণতি। বাংলাদেশে ঋতুভিত্তিক বর্ষা হয় এবং এই ধারাগুলোর পরিবর্তনের ফলে আবদ্ধ জলাশয় তৈরি হয়ে মশার জন্য আদর্শ প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগের সাম্প্রতিক তথ্য ইঙ্গিত করে, বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধরনের পরিবর্তনশীলতা মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জকে বাড়িয়ে তুলেছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, যার ফলে মিঠা পানির উৎসগুলোতে লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে। এই বর্ধিত লবণাক্ততা মশার জন্য নতুন প্রজনন আবাসস্থল তৈরি করতে পারে। কারণ মশার কিছু প্রজাতি লোনা পানির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের ক্রমবর্ধমান উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততার অনুপ্রবেশের সমন্বয় উপকূলীয় জনসংখ্যার জন্য একটি দ্বৈত হুমকি তৈরি করে। বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার প্রতিবছর আনুমানিক ৩ থেকে ৪ মিলিমিটার। তাই উপকূলীয় অঞ্চল এখন সবচেয়ে সংবেদনশীল। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে উপকূলীয় অঞ্চলে মশাবাহিত রোগ সংক্রমণের আশঙ্কাও অব্যাহত থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনার সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ঘটনাগুলো স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে, অবকাঠামোর ক্ষতি করে এবং মানুষকে স্থানচ্যুত করে। এই পরিস্থিতি মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাকে আরো চ্যালেঞ্জিং করে তোলে।
বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের মতো দুর্যোগ ২০২০ সালে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের স্থানচ্যুতি ঘটায়। এই ধরনের বিপর্যয় শুধু স্বাস্থ্যসেবা সংস্থানকেই চাপ দেয় না, বরং রোগ সংক্রমণের জন্য উপযোগী পরিস্থিতিও তৈরি করে। ক্রমবর্ধমান মশাবাহিত রোগ জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এটা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে চাপে ফেলছে। জনসংখ্যার ওপর একটি উল্লেখযোগ্য বোঝা তৈরি করছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর উচ্চমাত্রার বোঝা তৈরি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে হাসপাতালে ভর্তির হার এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বৃদ্ধি।
মশাবাহিত রোগের অর্থনৈতিক প্রভাব যথেষ্ট। এটা পরিবার, ব্যবসা এবং জাতীয় অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে। অসুস্থতা এবং স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট খরচের কারণে উৎপাদনশীলতা হারানো পরিবারগুলোর ওপর একটি উল্লেখযোগ্য বোঝা চাপছে এবং দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধিতে তা অবদান রাখছে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে শুধু ডেঙ্গুর অর্থনৈতিক ব্যয় ১.১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমান করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান মশাবাহিত রোগ মোকাবেলার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন, যা অভিযোজন এবং প্রশমন কৌশল উভয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। মশা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে কীটনাশকযুক্ত মশারীর ব্যবহার, গৃহ অভ্যন্তরীণ স্প্রে করা এবং প্রজনন স্থানগুলো হ্রাস করার জন্য লার্ভা-উৎস ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাগুলো ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমাতে সফল হয়েছে এবং অন্যান্য মশাবাহিত রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অভিযোজিত হতে পারে।
এখন জলবায়ু সহনশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোকে শক্তিশালী করা, চিকিৎসাসামগ্রী মজুদ করা এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের কার্যকরভাবে সক্রিয় করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
জনসচেতনতামূলক প্রচারণা মানুষকে রোগ প্রতিরোধ এবং স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধির গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করতে সাহায্য করতে পারে। এই প্রচারাভিযানগুলো জলবাযু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকি এবং কিভাবে তারা তাদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে সেই সম্পর্কেও জনগণকে অবহিত করতে পারে।
যদিও অভিযোজন ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্রশমন প্রচেষ্টার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণগুলো সমাধান করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা কমাতে এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী মশাবাহিত রোগের ওপর এর বিরূপ প্রভাব সীমিত করার জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ তার গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর প্রতিশ্রæতি দিয়েছে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির এবং বনায়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প শুরু করেছে। এই প্রচেষ্টাগুলো বিশ্বব্যাপী প্রশমনে অবদান রাখে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং মশাবাহিত রোগের ওপর এর প্রভাব মোকাবেলা করা একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। যার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশ অন্যান্য দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে অংশীদারির মাধ্যমে উপকৃত হতে পারে, যাতে এই স্বাস্থ্য হুমকিগুলো কার্যকরভাবে মোকাবেলায় সম্পদ, জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জন করা যায়।
এই সংকট মোকাবেলার প্রচেষ্টায় অভিযোজন এবং প্রশমন কৌশলগুলোর সংমিশ্রণ কাজ করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ, জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, জনসচেতনতামূলক প্রচারণা, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। এই কৌশলগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য সরকারি, বেসরকারি সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং চেয়ারম্যান, ক্যাপস

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *