ড. কবিরুল বাশার
বাংলাদেশে এই পর্যন্ত ১২৬ প্রজাতির মশা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় পাওয়া যাচ্ছে ১৬ প্রজাতির। উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের উত্তম জায়গা। বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনকেফালাইটিস।
পৃথিবীতে যত ক্ষতিকর প্রাণী আছে তার মধ্যে মশা অন্যতম। মশাই একমাত্র প্রাণী যে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ নিয়ে থাকে। মশার কামড়ে সৃষ্ট অসুখে প্রতিবছর বিশ্বে সাত লাখ ৫০ হাজার মানুষ মারা যায়। এই তথ্য জানিয়ে বিজনেস ইনসাইডার বলছে, তালিকায় মশার পর আছে মানুষ। প্রতিবছর মানুষের হাতে মারা পড়ে চার লাখ ৩৭ হাজার মানুষ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে সতর্কবার্তা জারি করেছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার তথ্য মতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা এখন প্রায় এক লাখ। ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে গত ২০ আগস্ট বিশ্বব্যাপী পালিত হয়েছে মশা দিবস।
১৯৩০ সাল থেকে প্রতিবছরের ২০ আগস্ট দিবসটি পালিত হচ্ছে। বিশ্ব মশা দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য-এখনো জানার অনেক বাকি। সত্যিই মশা রহস্যময় এক ঘাতক।
মশাবাহিত রোগ হাজার বছর ধরে মানুষের ইতিহাসে অসুস্থতা ও মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে লিপিবদ্ধ আছে। উনিশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ কেউই বুঝতে পারেনি যে মশা রোগের ভেক্টর ছিল।
প্রথম সাফল্য আসে ১৮৭৭ সালে, যখন ব্রিটিশ ডাক্তার প্যাট্রিক ম্যানসন আবিষ্কার করেছিলেন যে একটি কিউলেক্স প্রজাতির মশা মানুষের ফাইলেরিয়াল রাউন্ড ওয়ার্ম বহন করতে পারে। পরবর্তী দুই দশকে তিনি এবং ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য গবেষকরা ম্যালেরিয়া গবেষণায় মনোনিবেশ করেন, যা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলোতে একটি প্রধান ঘাতক। তাঁরা আস্তে আস্তে মানুষ ও মশার মধ্যে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ এবং জীববিজ্ঞানের জটিল সমীকরণ বুঝতে শুরু করেন।
জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবীব্যাপী বাড়ছে তাপমাত্রা। গলছে মেরু অঞ্চলের বরফ। বিপত্সীমা অতিক্রম করছে সমুদ্র ও নদীর পানির উচ্চতা। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী তিন দশকে ২১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবে। বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং সম্পদের ব্যবধান কমিয়ে আনার জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাহক বাহিত নতুন নতুন রোগ আসবে এবং পুরনো রোগ নিয়ন্ত্রণেও নতুন ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়া, নাগরিকদের শিক্ষাগত ঘাটতি এবং জীবনযাত্রার মান নিম্ন হওয়ায় বাংলাদেশের মতো মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে সংক্রামক রোগের প্রকোপ বেড়ে চলেছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট রোগের ঝুঁকি বাংলাদেশে বেশি।
বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৬ প্রজাতির মশা শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে ১৬ প্রজাতির মশা। উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া থাকার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের উত্তম জায়গা। বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনকেফালাইটিস।
ডেঙ্গু
২০০০ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় এবং ৫০০ মানুষ আক্রান্ত হয়। এরপর প্রতিবছরই কমবেশি ডেঙ্গু হয়েছে, তবে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেশবাসী সবচেয়ে বেশি দেখেছে ২০১৯ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাব অনুযায়ী এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ১৭৯ জন মারা যায়। এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু রেকর্ড করেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা এখন লাখ ছুঁই ছুঁই।
ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার দুটি প্রজাতি। যার একটি হলো এডিস ইজিপ্টি, আরেকটি হলো অ্যালবোপিকটাস। এডিস ইজিপ্টিকে শহুরে মশা বা নগরের মশা অথবা গৃহপালিত মশা বলা হয়। আর অ্যালবোপিকটাসকে বলা হয় এশিয়ান টাইগার মশা অথবা গ্রামের মশা। এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে জন্মায় এবং বর্ষাকালে এর ঘনত্ব বেশি হয়। তাই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এ সময় বেড়ে যায়।
চিকুনগুনিয়া
২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে, যেটি ডেঙ্গুর মতোই একটি রোগ। এই রোগ চিকুনগুনিয়া ভাইরাসবহনকারী এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়া রোগ শনাক্ত হয়। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয় ২০১৬-১৭ সালে।
ম্যালেরিয়া
বাংলাদেশসহ পৃথিবীব্যাপী মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম হলো ম্যালেরিয়া। অ্যানোফিলিস মশার সাতটি প্রজাতি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া ছড়ায়। এর মধ্যে চারটি প্রজাতিকে প্রধান বাহক বলা হয়। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা এবং সীমান্ত এলাকার মোট ১৩ জেলার ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
২০০০ সালের পর সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ২০০৮ সালে। ২০০৮ সালে ৮৪ হাজার ৬৯০ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং ১৫৪ জন মারা যায়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে এই সংখ্যা কমে রোগী হয় ১৭ হাজার ২২৫ জন। ২০২২ সালে বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ১৯৫ এবং মারা গেছে ১১ জন। এ বছর এখন পর্যন্ত আক্রান্ত প্রায় আট হাজার। ম্যালেরিয়া বাহক অ্যানোফিলিস মশা গ্রীষ্ম-বর্ষায় বেশি জন্মায় এবং এই সময়ে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।
ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগ
মশাবাহিত আরেকটি ভয়াবহ রোগের নাম ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগ। এটিকে কোনো কোনো জায়গায় ইলেফেনটিয়েসিসও বলা হয়। এ রোগে মানুষের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে হাতির পায়ের মতো হয়ে ওঠে। স্থানীয়ভাবে এই রোগটিকে গোদ রোগ বলা হয়ে থাকে।
ফাইলেরিয়া বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণের প্রায় ৩৪টি জেলায় কমবেশি পাওয়া যায়। একসময় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল, তবে সরকারের ফাইলেরিয়া এলিমিনেশন প্রগ্রামের মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
ফাইলেরিয়া নেমাটোড জাতীয় কৃমি; ইউচেরিয়া ব্যানক্রফটি বাহিত মশার দ্বারা সংক্রমিত হয়। কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি ও ম্যানসোনিয়া মশার একটি প্রজাতির মাধ্যমে বাংলাদেশে এ রোগ ছড়ায়।
জাপানিজ এনকেফালাইটিস
জাপানিজ এনকেফালাইটিস নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো গবেষণা নেই। কিউলেক্স মশার কয়েকটি প্রজাতি এ রোগ ছড়ায় বলে প্রমাণ আছে। বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সীমিত।
করণীয়
প্রজাতিভেদে মশার রোগ বিস্তারের ক্ষমতা, প্রজননস্থল, প্রজনন ঋতু ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ভিন্ন। তাই মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতার জন্য এর জীবনাচরণ সম্পর্কে জানা দরকার। মশার বায়োলজি, ইকোলজি, স্বভাব পর্যালোচনা করে এর নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ প্রয়োজন। একটি সময়োপযোগী আধুনিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এর সঠিক বাস্তবায়ন মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম চাবিকাঠি।
গবেষক, বিজ্ঞানী এবং ওষুধ তৈরি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ভ্যাকসিন আবিষ্কার। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন, এই অগ্রগতির আরেকটি কারণ। তবে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। মিউটেশন ও বিবর্তনের মাধ্যমে ভাইরাস পরিবর্তিত হয়ে দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে।
আমরা ধরে নিতে পারি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জীবাণুর অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতা বাড়বে। সফলভাবে এই জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমাদের মৌলিক গবেষণায় হাত দিতে হবে। গবেষণার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রস্তুতি রাখতে হবে যেন যেকোনো ধরনের রোগ আক্রমণকে মোকাবেলা করা যায়।
লেখক: কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক ও অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়