মোরশেদা ইয়াসমিন পিউ: দেশে মানসিক সমস্যাগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি অল্প হলেও শিশুদের মধ্যেও এ সমস্যা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা এর জন্য অনেকাংশে ইন্টারনেটকেও দায়ী করছেন।
সরকারি এক জরিপে দেখা গেছে, ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যা রয়েছে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশের। যা আগে ছিল ১৬.০৪ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হলো ষাটোর্ধ্ব। আর ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সী অর্থাৎ শিশুদের মধ্যে মানসিক সমস্যাগ্রস্তের হার ১৭.৭ শতাংশ। আগে যা ছিল ১৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বিষণœতা ব্যাপক আকার নেবে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসছেন না ৯১ শতাংশের বেশি মানুষ। অন্যদিকে পুরুষদের মধ্যে মানসিক রোগ নিয়ে বেশি সংস্কার ও নেতিবাচক ধারণা দেখা যায়। এমনকি সমস্যাগ্রস্ত কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসার হার ২ শতাংশেরও কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে আরও জোরালোভাবে এগিয়ে নিতে হবে। এমন প্রেক্ষাপটে ১০ আগস্ট উদযাপিত হয় বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস-২০২৩। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয় এই দিবস। ১৯৯২ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক অসুস্থতার কারণেই সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে, এ থেকে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। দেশে ২৫ শতাংশ মানুষ বিষণœতায় ভুগছেন। যাদের বেশিরভাগই কখনো চিকিৎসা পায়নি। অনেকে আত্মহত্যা না করে উলটো অন্য কোনো আপনজনকে হত্যা করার মতো অপরাধেও লিপ্ত থাকে। প্রতিদিন বিশ্বে গড়ে ৩ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছে। এর চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি লোক আত্মহত্যার চেষ্টা করছে।
অপর এক গবেষণায় মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের জন্য ইন্টারনেটকে দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে-ইন্টারনেট মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডে ইন্টারনেট কোনো না কোনোভাবে যুক্ত থাকে। কিন্তু ইন্টারনেট তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য অনেকাংশেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের করা জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে-শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৭২ দশমিক ২ শতাংশই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হন। এদের মধ্যে ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই বলছেন, তাদের মানসিক সমস্যায় ইন্টারনেটের ভূমিকা রয়েছে। বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের করা সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, মানসিক সমস্যায় ইন্টারনেটকে ‘পুরোপুরি দায়ী’ মনে করেন ২৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং ‘মোটামুটি দায়ী’ ভাবেন ৫৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। তবে মানসিক সমস্যার জন্য ইন্টারনেটকে দায়ী করেনি ৮ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া লেখাপড়ার বাইরে ইন্টারনেটের কারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছেন এবং ইন্টারনেটে আসক্তির কারণে পড়াশোনা হুমকিতে পড়ছেন। এছাড়াও পারিবারিক সম্পর্কে ঘাটতি, সামাজিক সম্পর্কেও পিছিয়ে পড়া, ব্যক্তি জীবনে বিরূপ প্রভাব, ঘুম ও শারীরিক সমস্যাসহ আচরণগত পরিবর্তনও দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট তানসেন রোজ বলেন, শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ অবসর সময় কাটানোর জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। বিশ্বায়নের যুগে ইন্টারনেট ব্যবহার না করলে আমাদের তরুণ প্রজন্মই পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু সমীক্ষা অনুযায়ী তারা ইন্টারনেটকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চান। সমস্যা সমাধানে আঁচল ফাউন্ডেশন কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে। এর মধ্যে আছে—ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে স্কুল, কলেজগুলোতে ‘ডিজিটাল লিটারেসি প্রোগ্রাম’ চালু করা, ইন্টারনেট রেসকিউ ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আসক্তি কাটিয়ে উঠতে কাউন্সিলিং, থেরাপি এবং শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম প্রদান করা, সামাজিক ও পারিবারিক যোগাযোগে ইন্টারনেট নির্ভরতার পরিবর্তে সরাসরি যোগাযোগকে উৎসাহিত করতে প্রচারণা চালানো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, আসলেই ইন্টারনেটের ব্যবহার এ বয়সী মানুষদের উপকার করছে নাকি অপকারটাই বয়ে নিয়ে আসছে। বিশেষ করে ১৯-৩০ বছর বয়সী যে তরুণ যুবক গোষ্ঠী আছে তাদের হতাশা, বিষণ্নতা এবং অন্যান্য সামাজিক-মানসিক অস্থিরতা আগের তুলনায় অনেক বেশি। এদের মধ্যে আত্মহত্যার হারও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট কিছুটা দায়ী বলেও প্রতীয়মান হচ্ছে।