এশিয়ার সেরা শতকে বাংলাদেশের ওয়াহিদুন্নেসা ও সেঁজুতি

এশিয়ার সেরা শতকে বাংলাদেশের ওয়াহিদুন্নেসা ও সেঁজুতি

সুমন্ত গুপ্ত: কিছু কিছু অর্জন দেশ এবং দেশের মানুষকে একসঙ্গে সম্মানিত করে, এগিয়ে দেয় দেশকে। এ তেমনই এক অর্জন। এবার এশিয়ার ‘শ্রেষ্ঠ ও মেধাবী’ ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন দুই বাংলাদেশি নারী। বাংলাদেশের নারীদের বিজ্ঞানচর্চায় যেন নতুন দুয়ার খুলে দিলেন তারা। গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০২৩ সালে প্রকাশিত তালিকায় জায়গা পান তারা। তালিকাটি তৈরি করেছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ম্যাগাজিন এশিয়ান সায়েন্টিস্ট। ১১ জুন ‘দ্য এশিয়ান সায়েন্টিস্ট ১০০’ শিরোনামে নিজেদের ওয়েবসাইটে তালিকার অষ্টম সংস্করণ প্রকাশ করেছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘এশিয়ান সায়েন্টিস্ট’। গবেষণা খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ২০১৬ সাল থেকে বিজ্ঞানীদের তালিকা প্রকাশ করে আসছে সাময়িকিটি। প্রতি বছর ১৭ ক্যাটাগরিতে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের পাশাপাশি তালিকায় রয়েছে চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, হংকং, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামও। সাসটেইনেবিলিটি খাতে অবদান রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী এবং লাইফ সায়েন্সে অবদানের জন্য চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) ড. সেঁজুতি সাহা তালিকায় জায়গা করে নেন। এ অর্জন বাংলাদেশের নারীদের বিজ্ঞানচর্চায় আরও বেশি উৎসাহিত করবে কোনো সন্দেহ নেই।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিপ্রাপ্ত সংরক্ষণ সংস্থা ওয়াইল্ডটিমের একজন বোর্ড সদস্য। এ সংস্থাটি বাংলাদেশে দ্রæতহারে হারিয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে কাজ করছে। এশিয়ার সেরা ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পাওয়া অধ্যাপক গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী, প্লাস্টিকের দূষণ এবং প্রকৃতি ও মানুষের জীবনে এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন। ২০২২ সালে জলজ প্রতিবেশ এবং বিপন্ন প্রাণী সুরক্ষায় অবদানের জন্য তিনি ওডব্লি্উএস ডি-এলসিভিয়ার ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড পান। উপক‚লীয় নারীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করছেন তিনি। ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী জুওলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সদস্য। বরেণ্য এ নারী বিজ্ঞানী কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় (জলভ‚মি পরিবেশবিদ্যা) বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের বিপন্ন জলাশয় ও প্রাণিকু‚ল নিয়ে গবেষণা করছেন। জেলেরা ব্যবহারের অনুপোযোগী নাইলনের জাল নদী বা জলাশয়ে ফেলে দেন, এটি প্লাস্টিকদূষণ। জেলেদের এ দূষণ বন্ধে কাজ করেছেন তিনি। বর্তমানে কাজ করছেন প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা ও এর ঝুঁকি নিয়ে।
‘এশিয়ান সায়েন্টিস্ট’ সাময়িকি জানিয়েছে, এ তালিকায় এমন সব গবেষক স্থান পেয়েছেন, যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনন্য। কাজের মাধ্যমে মানুষের জীবন ও পরিবেশের উন্নতিতে অবদান রাখছেন। এশিয়ার গবেষকরা বড় স্বপ্ন দেখা অব্যাহত রেখেছেন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা করে যাচ্ছেন। নিজের দলের সহায়তায় বাধা পেরিয়ে বিশাল সাফল্য অর্জন করেছেন তারা। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায় গত একদশকে নতুন করে এইআইভি/এইডস সংক্রমণের হার ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা, বাংলাদেশি শিশুদের মধ্যে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস ও মেনিনজাইটিসের সংযোগ শনাক্ত করা অন্যতম।
এ দুই নারী বিজ্ঞানীর অর্জন বাংলাদেশের নারীদের বিজ্ঞানচর্চায় পথ দেখাবে নতুন করে। ড. ওয়াহিদুন্নেসা ও সেঁজুতি সাহার মতো বিজ্ঞানীরা একই সঙ্গে পথ দেখাবে বাংলাদেশকেও।
ড. সেঁজুতি সাহা বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ তরুণ বিজ্ঞানী। বিশ্বে প্রথমবারের মতো তিনিই প্রমাণ করেন যে, চিকুনগুনিয়া ভাইরাস ব্লাড-ব্রেইন ব্যারিয়ার অতিক্রম করতে পারে এবং এটি বাংলাদেশি শিশুদের মধ্যে মেনিনজাইটিস সৃষ্টি করতে সক্ষম। সেঁজুতি সাহা ও সিএইচআরএফ প্রথম বাংলাদেশের রোগীদের মধ্য থেকে পাওয়া নমুনা থেকে নতুন করোনা ভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিনোম বিন্যাস উন্মোচন করেন। বাংলাদেশ থেকে ‘ও’ লেভেল শেষ করে ২০০৫ সালে কানাডার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে ভর্তি হন। জৈব রসায়নে স্নাতক শেষ করে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে আণবিক জিনতত্তে¡ পিএইচডি করেন। ২০১৮ সালে তিনি বিল গেটসের ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ২০২০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল পোলিও ইরেডিকেশন ইনিশিয়েটিভের বোর্ড মেম্বার নিযুক্ত হন। তার বাবা বাংলাদেশের আরেক প্রসিদ্ধ অণুজীববিজ্ঞানী ড. সমীর সাহা ও মা ড. সেতারুন্নাহার গণস্বাস্থ্যের গবেষক। চিকিৎসাবিজ্ঞানে গবেষণার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য সেঁজুতি সাহা ইতোমধ্যে দেশে ও দেশের বাইরে একাধিক পুরস্কারে ভ‚ষিত হয়েছেন। এ তালিকায় আছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনালের উইমেন অব ইন্সপায়রেশন ২০২১ অ্যাওয়ার্ড এবং ২০২২ সালে ওয়েবি অ্যাওয়ার্ড। ড. সেঁজুতি সাহা পোলিও ট্রান্সিশন ইনডিপেনডেন্ট মনিটরিং বোর্ডের (টিআইএমবি) একজন সদস্য। এছাড়া সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকাবিষয়ক কমিটিরও সদস্য হয়েছেন সেঁজুতি।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *