ইউরোপের তাপদাহ লক্ষণ মাত্র, রোগ পৃথিবীজুড়ে
নাভিদ সালেহ
গ্রিক পুরাণে বর্ণিত পাতালপুরীর রাজা হেইডিসের শিকারি সারমেয় ‘তিন মাথা সেরবেরাস’। এই ভয়ংকর প্রাণীটি পাতালপুরীর প্রহরী। মৃতরা পাতাল থেকে পালিয়ে যেতে চাইলে এই প্রহরী তার দানবীয় শক্তি দিয়ে প্রতিহত করে। ইউরোপে চলমান তাপপ্রবাহের নাম দেওয়ার ক্ষেত্রে এই হিংস্র পৌরাণিক চরিত্রকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
এবারের গ্রীষ্মে ইউরোপের বিভিন্ন শহরের তাপমাত্রা গড়ে ৫ থেকে ১০ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। রোম শহরে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। ইতালির সার্ডিনিয়া দীপাঞ্চলে তাপমাত্রা প্রায় ৪৭ ডিগ্রি ছুঁয়েছে জুলাইয়ের ১৮ তারিখে। স্পেনের লাইবেরিয়ো পেনিনসুলাতে তাপমাত্রা দাঁড়িয়েছে ৪৫ ডিগ্রি। গ্রিসেও তাপমাত্রা ৪৪-এ পৌঁছতে চলেছে।
ইউরোপজুড়ে এই অস্বাভাবিক তাপদাহের জন্য ‘প্রতি-সাইক্লোন’ শ্যারনকে দায়ী করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দক্ষিণ ভূমধ্যসাগরে একটি উচ্চচাপ আটকে রয়েছে, যা সাহারা মরুভূমির ধূলিকণার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাপমাত্রার উল্লম্ফন ঘটাচ্ছে। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বেড়েছে, যে কারণে উত্তপ্ত হাওয়া ধেয়ে আসছে দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের উপকূল ও দ্বীপাঞ্চলে।
এই তাপদাহ ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নেই। পারস্য উপসাগরের কাছে দক্ষিণ ইরানের একটি বিমানবন্দরে ১৭ জুলাই তাপমাত্রা দাঁড়িয়েছিল ৬৬ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই পরিমাপ সঠিক হয়ে থাকলে এটি পৃথিবীতে ধারণকৃত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর আগের রেকর্ড ছিল ১৯৯২ সালে দক্ষিণ ত্রিপলির সাহারা মরুভূমিতে; ৫৭ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি প্রায় অবিশ্বাস্য! তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রির ওপরে উঠলেই মানবদেহের কোষের স্থায়ী ক্ষতি ঘটতে শুরু করে। ইরানের এই তাপমাত্রায় কোনো মানুষ বা প্রাণী বেঁচে থাকতে পারবে না।
তাপদাহের আঁচ বাংলাদেশে এসেও লাগছে। এ বছরের গ্রীষ্মকাল ছিল প্রায় অসহনীয়। বর্ষাকালেও গরমে হাঁপিয়ে উঠছি আমরা। বিশ্বজুড়েই তাপদাহের কারণ যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন-তা নিয়ে দ্বিধা থাকার কথা নয়। তবুও উষ্ণায়ন ধারণার বিরোধীরা প্রশ্ন করেন, আবহাওয়া উষ্ণ হওয়া মানেই জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে– তা কী করে বলি? প্রশ্ন ছোড়েন, পৃথিবীর ইতিহাসে উষ্ণায়ন আর শীতলীকরণ কি চক্রাকারে ঘটেনি? বর্তমানের উষ্ণায়ন তাই আগামীর শীতলীকরণের পূর্বাভাস।
এটি সত্য, আবহাওয়া একটি স্বল্প সময়কে ধারণ করে আর জলবায়ু একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের পুরো মৌসুমকে ব্যাখ্যা করে থাকে। তবে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বল্প সময়ের আবহাওয়াও আমূল পাল্টে যেতে পারে। আবহাওয়া যদি নিয়মিত, দিনের পর দিন একই প্যাটার্ন প্রদর্শন করে, যেমন এ সময়ের অস্বাভাবিক তাপদাহ ঘটিয়ে চলেছে, তা জলবায়ুর ব্যারোমিটার বলে ধরা যেতেই পারে।
পৃথিবীর জলবায়ুতে উষ্ণায়ন ও শীতলীকরণ চক্রাকারে আবর্তিত হওয়া সম্পর্কে ‘নেচার’ পত্রিকায় ২০১৬ সালে প্রকাশিত নিবন্ধে ক্যারোলিন ডব্লিউ স্নাইডার সামুদ্রিক তাপমাত্রার ২০ হাজার উপাত্ত ব্যবহার করে গত ২০ লাখ বছরের তাপমাত্রার প্যাটার্ন উপস্থাপন করেছেন। সেখানে দেখা গেছে, প্রতি ৫০ হাজার বছরে বরফ যুগ এবং তার ৫০ হাজার বছর পর উষ্ণতার যুগ চলেছে। অর্থাৎ উষ্ণায়ন-শীতলীকরণের এ চক্রের যুক্তিটির ভিত্তি রয়েছে।
পৃথিবীর আদি ইতিহাসে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার চক্রাকারে বৃদ্ধি ও হ্রাসের প্রবণতাকে সার্বীয় বিজ্ঞানী লুটিন মিলানকোভিচ প্রথম বিশ্লেষণ করেন। যে কারণে এই চক্রাকার আবর্তনকে ‘মিলানকোভিচ সাইকেলস’ বলা হয়ে থাকে। এই তত্ত্বানুসারে, শীতলীকরণের অন্যতম কারণ পৃথিবীর কক্ষপথ প্রলম্বন। সেটা কীভাবে ঘটে? সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতির পরই শনি গ্রহের অবস্থান। বলয় থাকার কারণে শনির আয়তন বাস্তবে আরও বেশি। সৌরজগতের একই পাশে অবস্থানকারী এ দুই বৃহৎ গ্রহের প্রচণ্ড মহাকর্ষ বলের প্রভাবে একই রেখায় অবস্থানের সময় পৃথিবীর কক্ষপথ প্রলম্বিত হয়। এ সময়ে সূর্য থেকে দূরে অবস্থান করায় বরফ যুগের অবতারণা ঘটে থাকে। পৃথিবী আবার যখন কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে শনি ও বৃহস্পতি থেকে দূরে সরে আসে তখন সূর্যের নৈকট্যে উষ্ণায়ন ফিরে আসে। এভাবে প্রতি ৫০ হাজার বছরে পৃথিবীর উষ্ণায়ন-শীতলীকরণ চক্র আবর্তিত হয়।
স্নাইডারের নিবন্ধ দেখাচ্ছে- উষ্ণায়নের চূড়া কার্বন ডাই-অক্সাইডের চূড়া আর শীতলীকরণের খাদ কার্বন ডাই-অক্সাইডের খাদের সঙ্গে মিলে যায়। অর্থাৎ পৃথিবীর ইতিহাসে চক্রাকারে যখনই উষ্ণায়ন ঘুরে এসেছে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ তখন সর্বোচ্চ হয়েছে। একইভাবে যখনই বরফ যুগ এসেছে, কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ থেকেছে সর্বনিম্ন। কার্বনের সঙ্গে উষ্ণায়নের সম্পর্ক তাই ঐতিহাসিক।
তাহলে বর্তমানে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি কেন শঙ্কার উদ্রেককারী? এর উত্তর রয়েছে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্বের ইতিহাসে। গত ২০ লাখ বছরে কখনও কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব ২৮০ পিপিএমের বেশি হয়নি। এমনকি উষ্ণায়নের চূড়ার সময়েও নয়। অথচ শিল্পবিপ্লবের কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব ৪২০ পিপিএম ছাড়িয়ে গেছে। ভাবনার বিষয় এখানেই। স্নাইডারের সন্দর্ভ এও বলছে, কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব দ্বিগুণ হলে বায়ুমণ্ডলের তামপাত্রা বৃদ্ধি পাবে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
যাহোক, তাপমাত্রার বর্তমান মাত্রা আর উষ্ণায়নের ভবিষ্যৎ ঊর্ধ্বগতি পৃথিবীর জন্য ভয়াল চিত্র চিত্রণ করে চলেছে। আগামী বছরগুলোতে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ক্রমবর্ধমান থাকবে- এটি ধরে নেওয়া যেতে পারে। আজকের তাপমাত্রাই অনেক অঞ্চলের জন্য অসহনীয়। আগামীতে পৃথিবীর বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়, গ্রিক পুরাণের শিকারি কুকুর সেরবেরাসের সঙ্গে মহাভারতে বর্ণিত মৃত্যুদেব যমের কুকুর শবলের মিল রয়েছে। শবলও নরকের দরজা পাহারা দিত। তাই প্রতীচ্য হোক কিংবা প্রাচ্য, পাতালপুরীর ছবি যেমন ভয়াল, তেমনি এই ধরিত্রীর জলবায়ু উষ্ণায়নের বাস্তবতা প্রাচ্য-প্রতীচ্য নির্বিশেষে সবার জন্যই অমোঘ সত্য। এই বাস্তবতা থেকে পলায়নের যেমন কোনো উপায় নেই, তেমনি একে মোকাবিলা করা ছাড়াও আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই।
ইউরোপের তাপদাহ লক্ষণ মাত্র, রোগ ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। আমাদের শহর, গ্রাম, দেশের জন্য কী কী পদক্ষেপ নিলে উষ্ণায়নের কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারব, তা ভাবার সময় এখন। সেরবেরাস বা শবলের শিরচ্ছেদ সম্ভব না হলেও এই দানবকে অতিক্রম করা ছাড়া কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না।