ড. পিয়ার মোহাম্মদ
পৃথিবীতে সৃষ্ট প্রাণীর মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার পিছনে মানুষের মধ্যে যে গুণগুলো সদা-সর্বদা কাজ করে তা হলো তার বিবেক, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। বিবেক থাকার কারণে মানুষ ন্যায় অন্যায়, ভালো মন্দ, ধর্ম অধর্ম বিচার করতে পারে। বুদ্ধি থাকার কারণে মানুষ পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াইয়ে চলতে পারে। বিচক্ষণতার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে সব সময় সাবলীল ও সফল করে তুলে। আর আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানুষ সংযত ও সুসংবদ্ধ জীবন যাপন করে। এসব গুণ মানুষ হিসেবে সমাজে জীবন যাপনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। অথচ মানব জীবনে এ গুণাবলি কিছু কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। সেই কারণগুলো হলো ষড় রিপু। ষড় শব্দের অর্থ ছয় এবং রিপু অর্থ কন্টক বা শত্রু। অর্থাৎ ষড়রিপু বলতে বুঝায় মানব জীবনের ছয়টি শত্রু । কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ এবং মাৎসর্য হলো সেই চিহ্নিত ছয় শত্রু। মানুষের ভিতরে যদি এই শত্রুরা সব সময় কুমন্ত্রণা না দিতো তাহলে মানুষ স্বাভাবিক গুণাবলির আলোকে জীবন যাপন করতে পারত। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই শয়তান মানুষের পিছনে লেগে আছে। সে এই ষড় রিপুকে ব্যবহার করে মানুষকে সব সময় বিপথগামী করতে ব্যস্ত। মানুষও শয়তানের প্ররোচনায় ষড় রিপুর প্রলোভনে পড়ে পাপ কাজে হরহামেশাই লিপ্ত হয়ে পড়ে। পাপের কালিমায় মানব জীবনে নেমে আসে অমানিশা।
ষড় রিপুর প্রথমটি হলো কাম, যার আভিধানিক অর্থ কামনা, বাসনা, আসঙ্গ লিপ্সা ইত্যাদি। কামের প্রতিশব্দ হলো সম্ভোগেচ্ছা। কাম শব্দের অর্থ যেমন কামনা, তেমনি মনে যে ভাবের উদয় হলে নারী পুরুষের প্রতি বা পুরুষ নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয় তাকেও বলে কাম। এই কাম শক্তি যেমন মানুষকে বিপথগামী করে, তেমনি আবার মানব জীবনের জন্য অপরিহার্য। কাম শক্তি নেই এমন কোনো প্রাণী পৃথিবীতে নেই। এই শক্তি ব্যতিরেকে একজন মানুষ গতানুগতিক রীতিতে অসম্পুর্ণ মানুষ বলে বিবেচিত হয়। মানুষের বা অন্য প্রাণীর মধ্যে কামশক্তি না থাকলে পৃথিবীতে বংশ বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যেতো। পৃথিবী তার রূপ রস হারিয়ে ফেলত। সেজন্য মানুষের মধ্যে কাম থাকতে হবে, কিন্তু সেই কাম যখন মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং তার সাথে শত্রুতা করে তখনই সে রিপু হিসেবে বিবেচিত হয়। সে মানব জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে।
মহান আল্লাহ্ মানুষকে কোনো কিছুই অযথা দেন নাই। কাজেই কামও দেওয়া হয়েছে নিতান্ত প্রয়োজনেই। মানুষের আকাক্সক্ষা না থাকলে জীবনের কর্ম পদ্ধতি নতুন সংজ্ঞা পেতো। মানুষকে কর্মে নিয়োজিত করতে হলে তাদের পছন্দমত জিনিস দিতে হবে। অলিম্পিকে গোল্ড মেডেল গলায় ঝুলানোর ইচ্ছা থাকে বলেই খেলোয়াড়রা জীবন ভরে অনুশীলন করে। সেরূপ মানুষ মাত্রই থাকা চাই নিয়ন্ত্রিত কামশক্তি। নিয়ন্ত্রিত কামশক্তি মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। সেই সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার না করে যখন অনিয়ন্ত্রিত, বেপরোয়া ও বেসামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় তখন সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিজের সম্পদ যদি শয়তানের দখলে চলে যায়, তাহলে মানুষের বিপদগ্রস্ত হওয়ারই কথা। মানুষ তখন মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুত্ব বরণ করে নেয়। সে হয়ে উঠে চেহারায় মানুষ, কিন্তু কর্মে পশু। যেটা মানব জীবনের জন্য খুবই বেদনার।
মানুষ কাম রিপুর কুপ্রভাবে তাড়িত হয়ে ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়। এ ধরনের আচরণ মানুষের জীবনে জন্ম দেয় পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অবিশ্বাস, কলঙ্ক, শোক, সন্তাপ, অপমান, নিন্দা, লাঞ্চনা এবং ভর্ৎসনা। মানুষ যদি কাম রিপুর বশীভূত হয়ে তার দাসত্ব করে তাহলে সে চরিত্রহীন হয়, নিজেকে অপবিত্র করে ফেলে, জ্ঞান শুন্য হয়ে অমানুষে পরিণত হয় এবং ধর্মহীন হয়ে পাষণ্ড হয়। সে অসামাজিক ও অপ্রাকৃতিক কাজ করে এবং সমাজকে কলুষিত বা দূষিত করে। সে সমাজের কাছে হয়ে উঠে অবাঞ্চিত। কাম এবং ভালোবাসা কিন্তু এক জিনিস নয়। ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর, কোমল ও দুরন্ত মানবিক অনুভূতি। দুটি মনের অভিন্ন মিলনকে বলে ভালোবাসা। এ ভালোবাসার রূপকার মহান আল্লাহ্। ভালোবাসা হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য সুতোর টান। সে টানের কারণে কোনো দিন কাউকে না দেখেও তাদের মধ্যে ভালোবাসা হতে পারে। ভালোবাসার গভীর টানে রুহের গতির এক দিনের দূরত্ব পেরিয়েও দুই মু’মিনের সাক্ষাৎ হতে পারে। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে ভালোবাসতে হয়। সেজন্য কাম আর ভালোবাসাকে এক করে দেখার সুযোগ নেই।
কাম রিপু মানুষকে সকল কাজে এবং সকল প্রকার ধর্ম চর্চায় বাধা সৃষ্টি করে। মানুষের মন অজান্তেই সেদিকে ধাবিত হয়। কাম মানুষের জীবনের সব কিছু পণ্ড করে দেয়। মানুষের মনে আল্লাহর আরাধনা না থেকে কামের আরাধনা স্থান করে নেয়। সেজন্য কাম রিপুকে চরম মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। কাম রিপু নিয়ন্ত্রণ করে যখন বিশুদ্ধ প্রেমে বা ভালো কামনাতে পরিণত করা যায় তখন সে ভালো কামনার মাধ্যমে বেঁচে থাকার শক্তি পায়। মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, ঘর বাঁধে, সংসার ধর্ম পালন করে, ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে মহৎ উদ্দেশ্য গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আপ্রাণ চেষ্টা করে। জীবনে সুখী, সমৃদ্ধশালী ও সম্মানের অধিকারী হতে হলে তাকে অবশ্যই কাম রিপু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “সেদিন কোনো কাজে আসবে না ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততি। তবে কেবল সেই উপকৃত হবে, যে আল্লাহর কাছে পবিত্র বিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে উপস্থিত হবে।” (সূরা শু‘আরা ২৬: আয়াত ৮৮-৮৯) মহান আল্লাহ্ আরো এরশাদ করেন, “অবশ্যই সফলকাম হয়েছে সে ব্যক্তি, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে; আর বিফলকাম হয়েছে সে ব্যক্তি, যে নিজেকে পাপাচারে কলুষিত করেছে।” (সূরা শাম্স ৯১: আয়াত ৯-১০) সেজন্য আমাদের সবারই কাম রিপু দমন করে পবিত্র আত্মা নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়া জরুরি। কাম রিপু নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে সমাজে ব্যাভিচারী হয়ে আত্মাকে কলুষিত বানিয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হবে যা মানব জীবনের জন্য চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
কাম হলো নরকের দ্বার। মানুষকে নরকে টানার জন্য সবার মনে কামের উদ্ভব হয়। কাম থেকেই সব রিপুর জন্ম। সেজন্য কাম রিপু জয় করতে পারলে অন্যগুলো বশে আসে। কামাতুর মানুষ অমানুষে পরিণত হয় এবং সাধনার পথে অগ্রসর হতে পারে না। কাম যে কারণে ঘটে তা থেকে দূরে থাকলেও কাম থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। কাম বা কামনার কোনো শেষ নেই। চিন্তা ঘনিভূত হয়ে কাম সৃজিত হয়। কাম জন্ম নেয় ইন্দ্রিয় থেকে। তারপর সে মন ও বুদ্ধিকে মোহিত করে। মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে এর আবাসস্থল বা অবলম্বন। সেজন্য মানুষকে সব সময় ইন্দ্রিয়গুলোকে নিজের বশে রাখার চেষ্টা করা উচিৎ। এ কাম বেশি চর্চা করলে তা মানসিক স্বাস্থ্য ও দৈহিক স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে। সেজন্য কাম জয় করতে সংকল্প ত্যাগ করতে হয়। যে বিষয়ে কামের উদ্রেক হয় তা থেকে দূরে থাকার প্রয়োজন হয়। কামকে ভালো কাজে পরিণত করে তা থেকে উপকৃত হতে হয়। কামনাকে ব্যবহার করে মানুষ যখন আল্লাহ্কে পাওয়ার কামনায় মগ্ন হয় তখন তা হয় সাধনার পথে সহায়ক।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “আল্লাহর রং-এর চেয়ে উত্তম রং আর কার হতে পারে?” (সূরা বাকারা ২: আয়াত ১৩৮) হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “তোমরা আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হও।”। প্রতিটি রিপুই যেহেতু মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্ট সেহেতু প্রতিটির দক্ষ ব্যবহার কাম্য। টক, ঝাল, মিষ্টি, লবণ প্রতিটিই প্রয়োজন, কিন্তু অধিক ব্যবহারে প্রতিটিই ক্ষতিকর। কাম রিপুও তেমনি। এর সঠিক ব্যবহার যেমন অত্যাবশ্যক, তেমনি এর যথেচ্ছা ব্যবহার পরিত্যয্য। এ মর্মে মহান আল্লাহ্ বলেন, “তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। অবশ্যই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পন্থা।” (সূরা বনি ইসরাঈল ১৭: আয়াত ৩২) প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে কোনোভাবেই এ অশ্লীলতার নিকটে গমন করা যাবে না। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, “অশ্লীল আচরণের কাছেও যেও না তা প্রকাশ্য হোক কিংবা গোপন হোক।” (সূরা আন‘আম ৬: আয়াত ১৫১)। কাজেই কাম রিপুর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
ষড় রিপুর মধ্যে কাম রিপু সর্বাপেক্ষা দুর্জয় রিপু এবং মানুষের জন্য এক চরম শত্রু। পারিপার্শ্বিক ও বহিঃজগতের যে কোনো শত্রু এর কাছে হার মানতে বাধ্য। জাগতিক জীবনে যারা এ কাম শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারাই প্রকৃত প্রস্তাবে যৌন জীবনে লাভ করেছে সুখ, সমৃদ্ধি ও আদর্শ সংসার জীবন। নিয়ন্ত্রিত রিপু ঔষধের মতো কাজ করে এবং তা যথাস্থানে প্রয়োগ করে থাকে। আর অনিয়ন্ত্রিত রিপু নেশা জাতীয় দ্রব্যের মতো মাতাল করে এবং তা অপচয় করে ও অপাত্রে প্রয়োগের ফলে ক্রিয়া না করে প্রতিক্রিয়াতে পরিণত হয়।
মানব প্রকৃতির মধ্যে লজ্জা প্রবণতা জন্মগত এক অতীব স্বাভাবিক প্রবণতা। কাম রিপুর দাসত্ব প্রবল হলে নির্লজ্জতা মানুষকে আচ্ছন্ন করে এবং মানুষ পশুর পর্যায়ে চলে যায়। শয়তান মানুষের কাম রিপুকে অনিয়ন্ত্রণ করতে সব সময় প্রলুদ্ধ করতে থাকে। শয়তানের ধোকায় পড়ে মানুষ কাম রিপুর তাড়নায় এমন কাজ করে বসে যে জন্তু জানোয়াররাও তাকে ঘৃণা করে। কাম রিপুকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা জাগিয়ে অবাধ যৌনাচার থেকে বিরত থাকায় জীবনের বিধান। চরিত্রের উত্তম গুণাবলি দিয়ে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে কাম রিপুকে প্রতিরোধ করতে হয়। কাম থেকে বাঁচার জন্য কাম চিন্তা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করা দরকার। এভাবে এক সময় রেহাই পাওয়া যেতে পারে এ দিল্লীকা লাড্ডু থেকে। যারা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুলের উপর বিশ্বাসী তারা হৃদয়ের আবেগে বা নফসের কামনা-বাসনায় অনিয়ন্ত্রিত কামের সাথে আপস করে না।
নৈতিক শিক্ষা ও অনুশীলন কাম রিপু নিয়ন্ত্রণের সহায়ক হতে পারে তবে এ দিয়ে রিপুকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এ জ্ঞান চরম মুহূর্তে কাজে লাগে না। মানুষ জানে যথেচ্ছা কামাচার করা ঠিক নয়, কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতিতে পড়ে এ জ্ঞান সে কাজে লাগাতে পারে না। জেনেও সে রিপুর বশবর্তী হয়ে কামাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সেজন্য প্রয়োজন কাম রিপু নিয়ন্ত্রণের জন্য বাস্তব সম্মত জ্ঞান অর্জন করা। প্রয়োজন কাম রিপু নিয়ন্ত্রণে যার বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে তার সংস্পর্শে গিয়ে অনুশীলন করা। কাম রূপ পশু প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তার কাছেই শিক্ষা নিতে হবে যিনি এ পশুকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানেন। যিনি জানেন না তার কাছে হাজার পরামর্শ নিয়েও কাজ হবে না। আমার এ লেখা পড়েও কারো কাম রিপু নিয়ন্ত্রণ হবে না। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে একজন প্রশিক্ষকের কাছে গিয়েই শিখতে হবে। তাহলেই সফল হওয়া যেতে পারে।
মনে রাখতে হবে রিপু পুরোপুরি দমনের বিষয় নয়, এটি নিয়ন্ত্রণের বিষয়। সেজন্য কাম রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে। হযরত রাসুল (সা.) বলেন, “তোমাদের প্রত্যেকের সাথেই শয়তান নিযুক্ত রয়েছে।” এ কথা শ্রবণ করে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন- “ইয়া রাসুলাল্লাহ্ (সা.)! আপনার সাথেও কি আছে?” আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন- “হাঁ, আমার সাথেও। তবে মহান আল্লাহ্ আমাকে সাহায্য করেছেন, ফলে শয়তান আমার অনুগত হয়ে গিয়েছে। সে কেবল ভালো কাজেরই পরামর্শ দিয়ে থাকে।” (বোখারী ও মুসলিমের সূত্রে তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮১২) এতে বুঝা যায় আমাদের ভিতর কাম থাকবে তবে সেই কামকে মুসলমান বানাতে হবে। এ পশুটিকে লাগাম টেনে ধরা শিখতে হবে। একে মেরে ফেলা যাবে না। এটাতো আমাদের জীবনেরই অংশ। একে নিজের নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করে সফলকাম হতে হবে। আমরা যদি কাম নিয়ন্ত্রণ না করে তার নিয়ন্ত্রণে থাকি তাহলে কাম আমাদের পশু বানিয়ে রাখবে। তা হতে পারে না। বাড়ির কুকুরটা যেমন ঘেউ উে করে বিরক্ত করে বলে তাকে মেরে ফেললে বাড়ি পাহারা দেওয়ার কেউ থাকে না। সেজন্য তাকে বাঁচিয়ে রেখে তার ঘেউ ঘেউ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেরূপ কাম রিপুকে মেরে ফেললে নিজের ক্ষতি। এর লাগাম টেনে ধরে আমাদের কথামত তাকে চলতে বাধ্য করতে হবে।
এ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই সংকল্পবদ্ধ হয়ে একজন কামেল মোর্শেদের দরবারে গিয়ে তার কাছ থেকে কাম রিপু নিয়ন্ত্রণ কৌশল শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তারপর সেই মোতাবেক অনুশীলন করলে আস্তে আস্তে কাম রিপু নিয়ন্ত্রণ হবে। অনুশীলনের পথে নানা বাধা বিপত্তি আসতে পারে, মাঝে মাঝে ভুল এবং দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে, কিন্তু বিচলিত না হয়ে অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে। একদিন দেখা যাবে আপনিও হয়ে উঠেছেন কাম রিপু নিয়ন্ত্রণের একজন দক্ষ কারিগর। কাম রূপ পশুর নাকে দড়ি লাগিয়ে আপনি তাকে ব্যবহার করবেন। সে আর আপনাকে ব্যবহার করতে পারবে না। সেজন্য একজন কামেল অলী-আল্লাহর সহবতে যাওয়া খুবই জরুরি।
কাম রিপু খুবই শক্তিশালী। সেজন্য আল্লাহর অলীর এত্তেহাদি তাওয়াজ্জোহ ছাড়া একে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কেউ কামাসক্ত হয়ে পাপের কাজ করলে তার আত্মার সুরত সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে যায়। কাম রিপুর সুরত হচ্ছে শুকরের আকৃতি। কেউ কাম রিপুর বশবর্তী হয়ে মারা গেলে তার সুরত শুকরের সুরতে বিদ্যমান থাকে। কাম রিপুর তাড়নায় আক্রান্ত হয়ে যত ইবাদত মানুষ করুক না কেন তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। কাম রিপুকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সাধকগণ প্রতিদিন আল্লাহর পক্ষ থেকে এশার পর গাইরিয়াতের ফায়েজ, আর ফজরের নামাজের পর কুয়াতে এলাহিয়ার ফায়েজ মোরাকাবায় খেয়াল করে হাসিল করে থাকেন। মোরাকাবার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে এ রিপু নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
সেজন্য মানুষকে কামেল মোর্শেদের দেখানো পথে আমল করতে হয়। নিয়মিত মোরাকাবার মাধ্যমে ফায়েজ হাসিল করতে হয়। ফায়েজ হলো পরমাত্মার খোরাক। ফায়েজ পেয়ে পরমাত্মা শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং পশুর আত্মা বা হিংস্র পশুর আত্মা বা শয়তানের আত্মা দুর্বল হয়ে পড়ে। মানুষের কাম রিপু নিয়ন্ত্রিত হয়। তখন সে সুযোগ পেলেও কামের যথেচ্ছা ব্যবহারে আগ্রহী হয় না। কামের প্রতি তার কোনো আকর্ষণ থাকে না। এ ধরনের আত্মার পরিবর্তন ছাড়া কাম রিপু থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন।
আমাদের মহান দরদি মোর্শেদ দ্বিন দুনিয়ার কোহিনুর, মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, যুগের ইমাম, আম্বিয়ায়ে কেরামের ধর্মের দায়িত্ব ও বেলায়েত লাভকারী, যুগ শ্রেষ্ঠ তাসাউফ বিজ্ঞানী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) সারা জীবন মানুষকে কামসহ সকল রিপু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শান্তির চরিত্র ধারণ করে মহান রাব্বুল আলামিন ও দয়াল রাসুল (সা.)-এর করুণা পাওয়ার জন্য আশেকে রাসুলদের শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর শিক্ষানুযায়ী আশেকে রাসুলগণ ক্বালবে আল্লাহর জিকির জারি এবং আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে কাম রিপুর প্রভাবমুক্ত হয়েছেন। তাঁর ওফাতের পর মোহাম্মদী ইসলামের বর্তমান নেতৃত্বদানকারী মহামানব ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) একই শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সংস্পর্শে এসে অসংখ্য মানুষ কাম রিপু নিয়ন্ত্রণ করে সফলকাম হচ্ছেন।
মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা আমরা যেন এ মহান অলী-আল্লাহর কদম মোবারকে থেকে সাধনার মাধ্যমে কাম রিপু নিয়ন্ত্রণ করে সফলকাম হতে পারি। আল্লাহ্ আমাদের সহায় হবেন। আমিন।