দেওয়ানবাগ ডেস্ক: বৈশ্বিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির আঘাতে অর্ডার বা ক্রয়াদেশ কমছে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প কারখানাগুলোয়। দাম বাড়ছে পোশাকপণ্য উৎপাদনের কাঁচামালের। ক্রয়াদেশের অভাবে কমছে কারখানাগুলোর মুনাফা। আবার রপ্তানি হওয়া পোশাকপণ্যের অর্থ পরিশোধে গড়িমসি করছেন বৈশ্বিক ক্রেতারা। এর সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও তেলের দাম এবং সংকটকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন পোশাকশিল্প মালিকরা।
এ প্রসঙ্গে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিকেএমইএর কার্যকরি সভাপতি মোহাম্মাদ হাতেম বলেন, বর্তমানে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে পোশাকশিল্প। কারখানাগুলো কোনোভাবে ঠিকে থাকার চেষ্টা করছে। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তৈরি পোশাকপণ্যের অর্ডার অব্যাহতভাবে কমছে। এর সঙ্গে ব্যাংকিং সমস্যা বড় হয়ে দাঁঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক ক্রেতারা ঠিকমতো অর্থ পরিশোধ করছেন না। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ পরিশোধে গড়িমসি করায় বিপাকে পড়েছেন অনেক পোশাকশিল্প কারখানার মালিক।
পোশাকশিল্প মালিকদের আরেক সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ সহসভাপতি মোহাম্মদ শহিদুল আজিম বলেন, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকপণ্যের অর্ডার কমেছে। আগে যে ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান ৪ লাখ পিস পোশাকপণ্যের অর্ডার দিত, তারা এখন দিচ্ছে ৫০ হাজার পিসের। মূলত বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির ধাক্কা লেগেছে তৈরি পোশাকশিল্পে। ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান পুরো উৎপাদনশীলতা কাজে লাগাতে পারছে না। কম-বেশি সব কারখানাতেই উৎপাদনশীলতার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কাজ আছে। বাকি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদনশীলতার অপচয় হচ্ছে। আবার কাঁচামালের দাম বাড়ছে। ফলে কমছে মুনাফা।
সূত্র বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ফলে ওইসব দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আরেকটি বিষয় হলো বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ বাড়েনি, কিন্তু রপ্তানি আয় বেড়েছে। তার কারণ, কাঁচামালের দাম, ফ্রেইট কস্ট ও ইউটিলিটি খরচ বেড়েছে। সব মিলিয়ে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ বাড়লেও, রপ্তানির পরিমাণ বাড়েনি। বিদায়ী অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ১১ শতাংশ এবং ইউরোপের দেশগুলোয় গড়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ পোশাক রপ্তানি কমেছে।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলছে, ইউরোজোনের মূল্যস্ফীতি ফেব্রুয়ারিতে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। যা আগের মাসে ছিল ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। সিএনবিসি জানায়, এটি অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাসের ৮ দশমিক ২ শতাংশের থেকে বেশি। ফ্রান্স এবং স্পেনের মূল্যস্ফীতি ফেব্রুয়ারিতে অপ্রত্যাশিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা মূল্যসূচক গত মাসে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেশটির বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি অর্ডার আসে ইউরোপ ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সুতরাং এসব অঞ্চলে মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তাদের ওপর আরও চাপ বাড়াবে। যা বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পোশাকপণ্যের চাহিদা কমাবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবির তথ্যমতে, জুনে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ অর্জিত হলেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। গত বছরের এ সময়ে ৪ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানিতে বরাবরের মতোই অগ্রগামী অবস্থায় আছে দেশের পোশাক খাত। এ খাত থেকে এসেছে ৪৬ বিলিয়ন ডলার। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ।
সদ্যবিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার আর প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। নিটওয়্যার পোশাক রপ্তানি হয়েছে ২ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে (জুলাই-জুন) ওভেন পোশাক রপ্তানি ২১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ। নিটওয়্যার পোশাক রপ্তানি ২৫ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার, যেখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অর্থবছরে (জুলাই-জুন) মোট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার, আর প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। পুরো অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার, অর্জন হয়েছে ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার। এটি মোট লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় মাত্র ০ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।
বিজিএমইএর তথ্যমতে, ২০০৮-০৯ সালে উদীয়মান বাজারগুলোয় চালান ছিল ৮৪৯ মিলিয়ন ডলার এবং মোট পোশাক রপ্তানিতে অবদান ছিল ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারে এবং মোট রপ্তানিতে অবদান বেড়েছে হয়েছে ১৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ২০২০-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপ্রচলিত বাজারে শিপমেন্ট ছিল ৫ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার এবং রপ্তানিতে অবদান ছিল ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। সূত্র বলছে, বর্তমানে তৈরি পোশাকশিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং স্পিনিং, বয়ন ও ডাইং শিল্পসহ প্রাথমিক টেক্সটাইল খাতেও একই পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্পে আরও ২৫ বিলিয়ন ডলারের নতুন বিনিয়োগ আসতে পারে। পোশাক রপ্তানি থেকে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য আছে।