ড. মোহাম্মদ হান্নান: দুনিয়ার সপ্তম আশ্চর্যের যারা আবিষ্কারকর্তা, তারা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ঘর কাবাকে এ তালিকায় স্থান দেননি। কাবা বিশ্বের শুধু প্রাচীনতম ঘর নয়, এটি আল্লাহর দুনিয়ায় প্রথম ঘরও বটে। এর আগে দুনিয়ায় প্রার্থনা বা বাস করার জন্য কোনো ঘর স্থাপিত হয়নি। বস্তুত কাবাঘরের সৌন্দর্যও অপরূপ, যা হাজার হাজার বছর ধরে দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে মানুষকে আকর্ষণ করে রেখেছে।
প্রতিবছর আর কোনো স্থাপনাকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি মানুষের আবর্তনের ঘটনা দুনিয়ায় আর একটিও নেই।
এ ঘরের অনেক নাম আছে। প্রথমত কাবা, যার অর্থ ‘সম্মুখ’ বা ‘সামনে’। আরেকটি আছে বায়তুল্লাহ, এর অর্থ আল্লাহর ঘর।
একে হারাম শরীফও বলা হয়। কারণ এখানে যেকোনো প্রকার গুনাহ এবং যাবতীয় না-জায়েজ কাজ হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঝগড়া-বিবাদ, যুদ্ধও এখানে নিষিদ্ধ।
ইবনে কাসির হাদিস শরীফ বায়হাকির উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, ‘আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া দুনিয়ায় আগমনের পর আল্লাহ তায়ালা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে তাদের কাবাঘর নির্মাণের আদেশ দেন।
ঘর নির্মিত হয়ে গেলে তাদের তা তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।’ এ সময় আল্লাহ দুনিয়ার প্রথম নবি আদম (আ.)-কে বলেন, ‘হে আদম, আপনি দুনিয়ার প্রথম মানুষ এবং এ গৃহ মানবজাতির জন্য প্রথম ঘর।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)
মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলবি তাঁর কিতাবে এ ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেন, আল্লাহ তায়ালা যখন আদম (আ.)-কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় নামিয়েছেন, তখন তার সঙ্গে আল্লাহ তাঁর নিজের ঘরও নামিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘হে আদম, আমি আপনার সঙ্গে আমার নিজের ঘরও নামাচ্ছি। দুনিয়ায় এর তাওয়াফ করা হবে, যেমনটা আমার আরশে এর তাওয়াফ করা হয় এবং এর দিকে ফিরে এমনভাবে নামাজ পড়া হবে যেমন আমার আরশের দিকে ফিরে নামাজ পড়া হয়ে থাকে।’ [ফাজায়েলে হজ, অনুবাদ: মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের, দ্বীনি প্রকাশনী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ১৪৪০ হিজরি, পৃষ্ঠা ৮]।
কাবাঘরের এ স্থাপনা নূহ (আ.)-এর যুগ পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। কিন্তু নূহের যুগে যে মহাপ্লাবন সংঘটিত হয়, তাতে কাবাঘরের এ স্থাপনাও বিধ্বস্ত হয়। পরে ইবরাহিম (আ.) প্রাচীন ভিত্তির ওপর এই গৃহ পুনর্নির্মাণ করেন। মুফতি শাফি (রহ.) তাঁর পবিত্র কোরআন তাফসির কিতাবে লিখেছেন, ‘ইবরাহিম (আ.) এবং ইসমাঈল (আ.) কাবার প্রাথমিক ভিত নির্মাণ করেননি, বরং আগের ভিতের ওপরই কাবাঘর পুনর্গঠন করেন।’ [পবিত্র কোরআনুল করীম, মুফতি শাফি র. তাকসিরকৃত, কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, মদিনা, ১৪১৩ হি. পৃষ্ঠা ১৮৮]
সুরা হজেও উল্লিখিত হয়েছে, ‘যখন আমি ইবরাহিমের জন্য কাবাঘরের স্থান ঠিক করে দিলাম।’ [সুরা হজ: আয়াত ২৬]
এ থেকে আলেমরা সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে কাবাঘরের জায়গা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। কোনো কোনো কিতাবে বলা হয়েছে, ইবারাহিম (আ.)-কে কাবাঘর নির্মাণের আদেশ দেওয়ার পর ফেরেশতাদের মাধ্যমে বালুর স্তূপের নিচে পড়ে থাকা কাবাঘরের আগের ভিতকে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে এক দুর্ঘটনায় প্রাচীর ধসে গেলে কাবার পাশে বসবাসকারী জুরহাম গোত্রের লোকেরা একে পুনর্নির্মাণ করে। এভাবে কয়েকবার বিধ্বস্ত হওয়ার পর একবার আমালেকা সম্প্রদায় ও একবার কোরাইশরা এ গৃহ নির্মাণ করে। সর্বশেষ এ নির্মাণে মহানবি (সা.)-ও শরিক ছিলেন এবং তিনিই ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্থাপন করেছিলেন।
কিন্তু ইসলামপূর্ব যুগে কোরাইশদের এ নির্মাণের ফলে ইবরাহিম (আ.)-এর মূল ভিত্তি সামান্য পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রথমত একটি অংশ এর ‘হাতিম’ কাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, ইবরাহিম (আ.)-এর নির্মাণে কাবাগৃহের দরজা ছিল দুটি, একটি প্রবেশের জন্য এবং অন্যটি পশ্চাদমুখী হয়ে বের হওয়ার জন্য। কিন্তু কোরাইশরা শুধু পূর্বদিকে একটি দরজা রাখে। তৃতীয়ত, তারা সমতল ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে দরজা নির্মাণ করে, যাতে সবাই সহজে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। বরং তারা যাকে অনুমতি দেয় সে-ই যেন প্রবেশ করতে পারে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার হযরত আয়েশা (রা.)-কে বলেন, ‘আমার ইচ্ছা হয়, কাবাগৃহের বর্তমান নির্মাণ ভেঙে দিয়ে ইব্রাহিমের নির্মাণের অনুরূপ করে দিই। কিন্তু কাবাগৃহ ভেঙে দিলে নতুন মুসলিমদের মনে ভুল-বোঝাবুঝি দেখা দেওয়ার আশঙ্কার কথা চিন্তা করেই বর্তমান অবস্থা বহাল রাখছি।’ হযরত আয়েশা (রা.)-এর ভাগ্নে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) মহানবি (সা.)-এর উপরোক্ত ইচ্ছা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদিনের পর যখন মক্কার ওপর তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি উপর্যুক্ত ইচ্ছাটি কার্যে পরিণত করেন এবং কাবাঘরের নির্মাণ ইবরাহিম (আ.)-এর নির্মাণের অনুরূপ করে দেন। মাওলানা আমিনুল ইসলাম তাঁর তাফসির কিতাবে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের এ সংস্কার কাজ ৬৪ হিজরির ২৭ রমজানে শেষ হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। [তাফসিরে নূরুল কোরআন, আলবালাগ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পঞ্চম মুদ্রণ, ২০১২, পৃষ্ঠা ৪৪৫]।
কিন্তু হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর ইসলামপূর্ব জাহিলিয়াত আমলের কোরাইশরা যেভাবে নির্মাণ করেছিল, সেভাবেই পুনর্নির্মাণ করেন। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের পর কোনো কোনো বাদশাহ উল্লিখিত হাদিস অনুযায়ী কাবাঘরকে ভেঙে আবার নির্মাণ করার ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন ইমাম মালেক ইবনে আনাস (রা.) ফতোয়া দেন-‘এভাবে কাবাঘরের ভাঙাগড়া অব্যাহত থাকলে পরবর্তী বাদশাহদের জন্য একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়ে যাবে এবং কাবাঘর তাদের হাতে একটি খেলনায় পরিণত হবে।
কাজেই বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায়ই থাকতে দেওয়া উচিত।’ সমগ্র মুসলিম সমাজ তাঁর এ ফতোয়া গ্রহণ করে নেয়। তবে মেরামতের প্রয়োজনে ছোটখাটো কাজ সব সময়ই অব্যাহত থাকে। মাওলানা আমিনুল ইসলাম তাঁর তাফসির কিতাবে লিখেছেন, ‘কোশাই বিন কিলাব নামের একজন কাবাঘরের সংস্কার করেছিলেন এবং তিনি প্রথম কাবাঘরকে গিলাফ দ্বারা আবৃত করেন।’ [তাফসিরে নূরুল কোরআন, প্রথম খণ্ড, আলবালাগ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পঞ্চম মুদ্রণ, ২০১২, পৃষ্ঠা ৪৪৪]।
কাবাঘর বানানোর পর আল্লাহ তায়ালা এ ঘর এবং এ ঘরের চারপাশকে ‘নিরাপদ’ বলে ঘোষণা করেন:
১. ‘ওরা কি দেখে না আমি কাবাঘরের চারপাশ যা হারাম শরিফ বলে পরিচিত, তাকে নিরাপদ বলে ঘোষণা করেছি।’ [সুরা আনকাবুত: আয়াত ৬৭]
২. ইবরাহিম (আ.)-ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ, মক্কাকে নিরাপদ শহর করে দিন।’ [সুরা বাকারা২ : আয়াত ১২৬]
৩. ‘যে কেউ কাবাগৃহে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ।’ [সুরা আলে-ইমরান ৩: আয়াত ৯৬-৯৭]
৪. ‘মসজিদুল হারামের কাছে (কাবার কাছে) যুদ্ধ কোরো না।’ [সুরা বাকারা ২: আয়াত ১৯১]
৫. ‘আমার ঘরকে পবিত্র রেখো।’ [সুরা হজ: আয়াত ২৬]
৬. ‘আমি কাবাঘরকে মানুষের মিলনক্ষেত্র ও আশ্রয়স্থল হিসেবে তৈরি করেছি।’ [সুরা বাকারা ২: আয়াত ১২৫]
তাই কাবাঘর হলো দুনিয়ার মধ্যে একটি বিশেষ নিরাপদ স্থান। দুনিয়ায় এ রকম আরেকটি দৃষ্টান্তও নেই। এটা ইমানদারদের জন্য একটি মিলনক্ষেত্র এবং আশ্রয়স্থলও। তবে যারা অবিশ্বাসী, ইমানহীন এবং আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে, আল্লাহর অংশীদার বানায়, তারা কাবাঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। [সুরা তাওবা ৯: আয়াত ২৮]