হজের পরতে পরতে ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মৃতি

হজের পরতে পরতে ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মৃতি

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা
হজ ইসলামের অন্যতম মৌলিক একটি ইবাদত, যা নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে নির্দিষ্ট কর্মপন্থার আলোকে সম্পাদন করতে হয়। সুনির্দিষ্ট স্থানে হজের বিধান পালন করতে হয়, বিধায় হজ ফরজ হওয়ার ক্ষেত্রে সেখানে যাওয়া, অবস্থান করা এবং তত দিন পর্যন্ত পরিবারের রসদপত্র জোগান দেওয়ার সামর্থ্যের প্রসঙ্গ আসে। কাজেই সামর্থ্যবানদের ওপর হজ ফরজ হয় এবং জীবনে তা একবারই।


হজের আনুষ্ঠানিকতায় একটি বড় অংশজুড়ে আছে ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পরিবারের আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার স্মৃতিময় আমল।
ইব্রাহিম (আ.)-এর কাবা নির্মাণ: পৃথিবীর সর্বপ্রথম গৃহ হলো কাবা, যা মানুষের কল্যাণে নির্মিত সর্বপ্রথম উপাসনালয়। কালক্রমে কাবা বিধ্বস্ত হয়ে যায়। যখন ইব্রাহিম (আ.) স্ত্রী হাজেরা ও শিশু ইসমাঈলকে মক্কায় রেখে যান তখন কাবার দৃশ্যমান কোনো চিহ্ন ছিল না। এরপর ইসমাঈল (আ.) পিতার কাজে সহযোগিতা করার মতো বয়সে পদার্পণ করার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রতি কাবাগৃহ নির্মাণের নির্দেশ আসে।


আল্লাহর নির্দেশনায় তিনি স্বীয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে নিয়ে কাবা পুনর্র্নির্মাণ করেন। সে কাবাই মুসলিম উম্মাহর কিবলা ও হজের মূলকেন্দ্র। আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, যখন ইব্রাহিম ও ইসমাঈল কাবাগৃহের প্রাচীর তুলছিলেন, তখন তারা বলেছিল, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের এই কাজ গ্রহণ করো, নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা।’ (সুরা বাকারা ২: আয়াত ১২৭)


মাকামে ইবরাহিম: যে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে ইব্রাহিম (আ.) কাবাগৃহ নির্মাণ করেছিলেন সেটি হলো মাকামে ইব্রাহিম।
কাবাগৃহ নির্মাণকালীন পদচিহ্নবিশিষ্ট সেই পাথর আজও সেখানে বিদ্যমান রয়েছে। তাওয়াফের পর সেখানেই দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। আল্লাহ বলেন, ‘এবং সে সময়কে স্মরণ করো, যখন কাবাগৃহকে মানবজাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম এবং বলেছিলাম, তোমরা মাকামে ইবরাহিমকে নামাজের স্থানরূপে গ্রহণ করো।’ (সুরা বাকারা ২: আয়াত ১২৫)


হজের জন্য ইব্রাহিম (আ.)-এর আহ্বান: ইব্রাহিম (আ.) ইরাকে জন্মগ্রহণ করেন ও ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করেন। পরে আল্লাহ তায়ালার হুকুমে স্ত্রী ও শিশু সন্তান ইসমাঈলকে মক্কায় রেখে আসেন।
ইবরাহিম (আ.) ছেলে ইসমাঈলকে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর নির্মাণ করে মানুষকে বায়তুল্লাহর হজ করার জন্য আহ্বান করেন। আল্লাহ বলেন, ‘এবং স্মরণ করো, যখন আমি ইব্রাহিমের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম সেই গৃহের স্থান, তখন বলেছিলাম, আমার সঙ্গে কোনো শরিক স্থির করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রেখো তাদের জন্য, যারা তাওয়াফ করে এবং যারা নামাজে দাঁড়ায়, রুকু করে ও সিজদা করে এবং মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে, তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে ও ক্ষীণকায় উটের পিঠে, তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে। যাতে তারা তাদের কল্যাণকর স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে। (সুরা হজ ২২: আয়াত ২৬-২৮)


সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌড়ানো: হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে স্ত্রী হাজেরাকে পুত্র ইসমাঈলসহ মক্কায় রেখে যাওয়ার পর মা হাজেরা দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে জনশূন্য এই প্রান্তরে অবস্থান করতে থাকেন। একসময় কঠিন পিপাসা তাঁকে পানির খোঁজে বের হতে বাধ্য করে। তিনি শিশুকে রেখে সাফা-মারওয়া পাহাড়ে বারবার দৌড়ান। সাতবার ছোটাছুটি করেও পানির সন্ধান না পেয়ে শিশুর কাছে ফিরে আসেন। হাজেরা (আ.)-এর সেই সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়ানোই হাজিদের সাঈ বাইনাস সাফা ওয়া মারওয়া। যে পাহাড়দ্বয়কে মহান আল্লাহ নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই সাফা-মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। সুতরাং যে কেউ কাবাগৃহের হজ বা ‘উমরা সম্পন্ন করে এই দুটির মধ্যে সাঈ করলে তার কোনো পাপ নেই।’ (সুরা বাকারা ২: আয়াত ১৫৮)


হাজিদের পানীয় জমজমের পানি: হাজেরা (আ.) সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার ছোটাছুটি করে পানির সন্ধান না পেয়ে ফিরে আসার পর আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয়। জিবরাইল (আ.) এসে শুষ্ক মরুভূমিতে পানির একটি ঝরনাধারা বইয়ে দেন। এই ধারাই জমজম কূপ। পানির সন্ধান পেয়ে জীব-জন্তু আসতে থাকে। জীব-জন্তু দেখে মানুষ এসে বসতি গড়তে থাকে। এভাবে একদিন গড়ে ওঠে মক্কানগরী। হাজিদের পানীয় হিসেবে স্বীকৃতি পায় সেই জমজমের পানি।


শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ: একদিন ইবাহিম (আ.) স্বপ্নে দেখেন, তিনি স্বীয় পুত্র ইসমাঈলকে জবাই করছেন। তিনি বুঝতে পারলেন-ইসমাঈলকে কোরবানি করতে হবে। তিনি পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে স্বপ্নের কথা অবহিত করলেন এবং তার অভিমত জানতে চাইলেন। ইসমাঈল (আ.) জবাব দিলেন, ‘হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। (সুরা সাফফাত, আয়াত ১০২)
এবার পিতা পুত্রকে জবাই করতে এবং পুত্র জবাই হতে প্রস্তুত হলেন। যখন তারা দুজন আল্লাহর নির্দেশ পালনে এগিয়ে চললেন, পথিমধ্যে শয়তান তিনবার ইবরাহিম (আ.)-কে প্রতারিত করার চেষ্টা করে। ইব্রাহিম (আ.) প্রতিবারই শয়তানকে সাতটি করে কংকর নিক্ষেপের মাধ্যমে তাড়িয়ে দেন। প্রসংশনীয় এই কাজের স্মৃতি স্মরণ করে হাজিরা মিনায় তিনবার তিন স্থানে সাতটি করে কংকর নিক্ষেপ করেন। আয়শা (রা.) হতে বর্ণিত, হযরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘কংকর নিক্ষেপ ও সাফা-মারওয়ার মধ্যে দৌড়ানোকে আল্লাহর স্মরণের মাধ্যম সাব্যস্ত করা হয়েছে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৯০২)


কোরবানি: ইব্রাহিম (আ.) পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে নিয়ে কোরবানির স্থান মিনায় গিয়ে কোরবানির উদ্দেশ্যে ছুরি চালাতে লাগলেন। কিন্তু ছুরিতে কাটছিল না। আর তখনই অদৃশ্য থেকে আওয়াজ আসে-‘হে ইব্রাহিম, তুমি তো স্বপ্নদেশ সত্যই পালন করলে। এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত ১০৪-১০৬)


সেই আওয়াজ শুনে ইবরাহিম (আ.) তাকালে জিবরাইল (আ.)-কে একটি দুম্বা নিয়ে দাঁড়ানো দেখতে পান। তিনি আল্লাহর নির্দেশে পুত্রের পরিবর্তে সেটি কোরবানি করেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাকে মুক্ত করলাম এক কোরবানির বিনিময়ে।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত ১০৭)
সেই ধারাবাহিকতায় মিনার প্রান্তরে হাজিরা কোরবানি করেন। আর পুরো মুসলিম উম্মাহ আপন আপন জায়গায় (ঈদুল আজহায়) কোরবানি করে। আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহিম (আ.)-এর ঐতিহাসিক কোরবানি প্রসঙ্গ বর্ণনা করার পর বলেন, ‘আর আমি ইহা পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি। ইব্রাহিমের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক।’ (সুরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০৮-১০৯)


পরিশেষে বলা যায়, হযরত ইবাহিম (আ.) ও তাঁর পরিবারের আত্মত্যাগ, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার যে প্রতিচ্ছবি মক্কার জনপদে ছড়িয়ে আছে, সেই আধ্যাত্মিকতার পূর্ণরূপ হলো মুসলিম উম্মাহর হজ।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *