দেওয়ানবাগ ডেস্ক: ভারতের নতুন সংসদ ভবনে ম্যুরালের মাধ্যমে ‘অখণ্ড ভারতের’ এক মানচিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেই অখণ্ড ভারতের মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার। নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কুমার দহলের (প্রচণ্ড) ভারত সফরের সময় এ ম্যুরাল নেপালের রাজনীতিতে ঝড় তুলেছে। ভবিষ্যতে এ বিতর্ক ভারতের অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোতেও বড় হয়ে দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ম্যুরালে নেপালের লুম্বিনীকে অখণ্ড ভারতের অঙ্গ হিসেবে দেখানো হয়েছে। গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী নেপালিদের কাছে এক পবিত্র স্থান ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা তাদের এক অনন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। দেশের পর্যটন মানচিত্রে অন্যতম প্রধান আকর্ষণও।
দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি নতুন সংসদ ভবন তৈরির উদ্যোগ নেন। তবে কোভিড পরিস্থিতিজনিত অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে প্রায় এক হাজার কোটি রুপি খরচ করে এ ভবন তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়ার শুরু থেকেই সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি
ভারতের নতুন সংসদ ভবন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২৮ মে হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা বিনায়ক দামোদর সাভারকরের জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সংসদ ভবন উদ্বোধন করেন। সংসদের অভিভাবক রাষ্ট্রপতি। কিন্তু তাঁকে দিয়ে কেন তা উদ্বোধন করানো হলো না, সেই বিতর্কে দেশের বিরোধীরা সরব হন। প্রতিবাদ হিসেবে ২৪টি রাজনৈতিক দল ওই অনুষ্ঠান বর্জন করে। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুধর্ম অনুযায়ী পূজা ও হোমযজ্ঞ করে নতুন ভবনটি উদ্বোধন করা হয়। বিতর্ক বাধে তা নিয়েও। এবার নতুন বিতর্ক ‘অখণ্ড ভারতের’ মানচিত্র নিয়ে।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডের দিল্লি সফরের মধ্যেই নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাবুরাম ভট্টরাই এক বিবৃতিতে এ বিতর্কের অবতারণা করেন। তিনি বলেন, ‘এই মানচিত্র নেপালসহ ভারতের অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রে অহেতুক ও ক্ষতিকর বিতর্কের জন্ম দিতে পারে। বিভিন্ন প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারতের যে বিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে, তা বাড়িয়ে দেওয়ার মতো উপাদান এ মানচিত্রে রয়েছে। বিষিয়ে তুলতে পারে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক।’
নেপালের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শুরুর আগেই সে দেশের গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
ভবনটির ভেতরে ভারতের বিভিন্ন এলাকার ঐতিহ্যপূর্ণ উপকরণ ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ত্রিপুরার ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ব্যবহার করে পার্লামেন্টের মেঝে তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া ভবনটি নির্মাণে মহারাষ্ট্রের নাগপুর থেকে আনা সেগুনকাঠ, রাজস্থানের লাল ও সাদা বেলেপাথর, গ্রানাইটসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দমন ও দিউ থেকে ফলস সিলিং আনা হয়েছে
ভারত ও নেপালের মধ্যে কালাপানিকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলছে। ২০১৯ সালে ভারতের একটি রাজনৈতিক মানচিত্রে কালাপানিকে উত্তরাখন্ড রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়েছিল। পাল্টা মানচিত্র বের করেছিল নেপাল। দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ অনেক দিনের। গত বৃহস্পতিবার নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহল ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদিও বলেছেন, বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যাবতীয় বিরোধ তাঁরা মীমাংসা করবেন।
গত বৃহস্পতিবার দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হলে তাঁকে মানচিত্র বিতর্কের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। পররাষ্ট্রসচিব অবশ্য কোনো মন্তব্য করেননি। তবে সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশি এক টুইটে নতুন সংসদ ভবনে ‘অখণ্ড ভারতের’ ম্যুরালের ছবি দিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘সংকল্প স্পষ্ট, অখণ্ড ভারত।’
বিজেপি যে ভারতকে ক্রমেই হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে, সে অভিযোগ বিরোধীরা অনেক দিন ধরেই করে আসছে। হিন্দু রীতিতে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন, হিন্দু পূজারি ও পুরোহিতদের সমাবেশ এবং অখণ্ড ভারতের মানচিত্র সরকারের সেই উদ্দেশ্য স্পষ্টতর করে দিচ্ছে বলে বিরোধীদের অভিমত।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ মনে করে, প্রাচীনকালের গান্ধার (কান্দাহার) থেকে ব্রক্ষ্মদেশ (মিয়ানমার) ও তিব্বত-নেপাল থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতি। এই অখণ্ড ভূমিই তাদের কাছে ‘অখণ্ড ভারত’। সংঘ এখনো মনে করে, অতীতে যা ছিল ‘সিন্ধু’ সভ্যতা, তা আদতে ‘হিন্দু’ সভ্যতা। সেই সভ্যতার বিকাশ তারা নতুনভাবে ঘটাতে চায়।