বিজ্ঞান ডেস্ক: হাসি-কান্না, দুঃখ-কষ্টের মতো একাকিত্বও মানুষের এক ধরনের অনুভূতি। যুগ যুগ ধরে কবি, সাহিত্যিক, গীতিকাররা নিজ নিজ ভাষার মাধ্যমে এটি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সম্প্রতি গবেষকরা একাকিত্বকে অনুভূতির চেয়ে রোগ হিসেবেই দেখছেন। তাদের মতে, একাকিত্ব এক ধরনের অসুস্থতা। এটি মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে।
বেশকিছু গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগের অভাবের কারণে মানুষের মধ্যে একাকিত্ববোধ তৈরি হচ্ছে। একাকিত্ব তৈরির অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটি অন্যতম। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিকভাবে যোগাযোগ না করা একদিনে ১৫টি সিগারেট পানের চেয়েও বিপজ্জনক। এমনকি স্থূলতার চেয়েও ক্ষতিকর।
একাকিত্বের বিষয়টিকে মানসিক অসুস্থতা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এটি একপর্যায়ে মানসিক থেকে শারীরিক অসুস্থতায় রূপান্তরিত হয়। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকা, অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করা, মানসিকভাবে কষ্ট পাওয়া, অধিক দুশ্চিন্তা করা-এসব মানুষকে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। একাকিত্বের স্থায়িত্ব দুই সপ্তাহের বেশি হওয়া শরীরের জন্য হুমকিস্বরূপ।
উচ্চরক্তচাপ, অবসাদগ্রস্ততা, হূদরোগ, স্ট্রোকসহ অ্যালঝেইমার্স রোগ দেখা দিতে পারে। প্রদাহ বৃদ্ধির কারণে এসব রোগ দেখা দেয়। আর প্রদাহের সঙ্গে দুরারোগ্যের যোগসূত্র রয়েছে। একাকিত্বে ভুগতে থাকা মানুষের অকালে মারা যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিঃসঙ্গ মানুষের অকালে মৃত্যুর আশঙ্কা ২৬ শতাংশ বেড়ে যায়।
এছাড়া যেসব মানুষের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাত্রা খুবই কম বা নেই বললে চলে, তাদের ক্ষেত্রে এটি বেড়ে যেতে পারে। ২৯ শতাংশ কখনো বা এটি বেড়ে ৩২ শতাংশ হয়ে যেতে পারে। এ কারণে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ডায়েট, ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্কের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।
সাধারণত তরুণ ও বৃদ্ধরা নিঃসঙ্গতায় বেশি ভোগেন বলে মনে করা হয়। ২০ বছরের নিচে যেসব তরুণ রয়েছে, তাদের মধ্যে এ সম্ভাবনা বেশি। এ তরুণরা যখন ভাবে যে তারা যথেষ্ট সামাজিক যোগাযোগ করতে পারছে না, অনেক বন্ধু তৈরি করতে পারছে না, তাদের জন্য কেবল কিছু মোবাইল বা কম্পিউটার গেম রয়েছে, তখন তারা একাকিত্বে ভুগতে থাকে।
অন্যদিকে তরুণদের বিপরীতে বৃদ্ধ বয়সের মানুষদের একাকিত্ব কাটিয়ে ওঠার মানসিক সক্ষমতা অনেক বেশি। বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের মতে, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষরা আমাদের ভাবনার চেয়েও অধিক সুখী। তবে গবেষকরা বলছেন, নিঃসঙ্গতার কারণে মাঝবয়সী মানুষরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। তাদের মধ্যে একাকিত্ব দেখা দেয়, যখন তারা নিজেদের মধ্যে অসন্তুষ্টি অনুভব করতে থাকেন।
অথচ মাঝবয়সী মানুষরাই পরিবার, সন্তান, সহকর্মী, বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করে। বাবা-মায়ের মৃত্যু, বিবাহবিচ্ছেদ, চাকরি হারানো এসব কারণেও মানুষ নিঃসঙ্গতায় ভুগতে থাকে। একাকিত্ব মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার অন্তরায়। তাহলে প্রশ্ন হলো, একাকিত্ব থেকে নিজেদের দূরে রাখার উপায় কী? নিঃসঙ্গতা একদিনে দূর করা সম্ভব নয়। তবে একেবারেই যে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না, তা কিন্তু নয়।
এজন্য দরকার ব্যক্তির একটুখানি সদিচ্ছা। অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, মানুষকে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে হলে বেশি বেশি সামাজিক যোগাযোগ করতে হবে। এ যোগাযোগ সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে করলে হবে না। করতে হবে মুখোমুখি যোগাযাগ। আড্ডা, গল্পে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে হবে। সামাজিক মাধ্যমগুলো মানুষের মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করে ঠিকই, কিন্তু এগুলো দূরত্বও তৈরি করে।
সামাজিকভাবে যোগাযোগে লিপ্ত থাকার পাশাপাশি একাকিত্ব দূরীকরণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আরো বেশকিছু পরামর্শের কথা বলেছেন। পুরনো বন্ধুদের খুঁজে বের করতে হবে এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। অপরিচিত ব্যক্তি হতে পারে ড্রাইভার, অফিসের কর্মচারী। অন্তত ৩০ মিনিট অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
এটা মনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যায়াম ও ঘুম শরীরের জন্য খুব দরকার। এতে মন ভালো থাকে, সেই সঙ্গে শরীর সুস্থ থাকে। নানা সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে হবে। এগুলো হতে পারে নাচ, গান, ছবি আঁকা, মেডিটেশন ইত্যাদি। এসব কাজে মস্তিষ্ক সচল থাকে। একই সঙ্গে নতুন নতুন বন্ধুও তৈরি হয়।
যে বিষয়গুলো আপনাকে মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়, সেই বিষয়গুলোর প্রতি অধিক মনোযোগী হতে হবে এবং এগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকা পালন করা অর্থাৎ অন্যকে সাহায্য করা। গবেষণায় দেখা গেছে, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজকর্ম মানুষের সামনে একটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাজির করে। এটা ব্যক্তির মধ্যে আত্মমর্যাদা বোধ তৈরি করে দেয়। এতে করে সেই ব্যক্তির একাকিত্ব ভাবটি অনেকাংশে দূর হয়ে যায়।