ক্বালবি বিদ্যার প্রয়োজনীয়তা
মো. আবদুল কাদের: মানব জীবনে ক্বালবি বিদ্যার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ক্বালবি বিদ্যা অর্জনের মাধ্যমে মানুষ নির্মল চরিত্রের অধিকারী হতে পারে এবং আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভে সক্ষম হয়। ক্বালবি বিদ্যা হচ্ছে আল্লাহ্কে জানার বিজ্ঞান। সমস্ত নবি-রাসুল ক্বালবি বিদ্যায় বিদ্বান ছিলেন। তাঁরা ক্বালবের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র পথ থেকে যা নির্দেশ পেয়েছেন, তা জাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত রাসুল (সা.) দীর্ঘ ১৫ বছর হেরা গুহায় ধ্যান-সাধনা করে রেসালাতের বাণী লাভ করেছিলেন- ইহা ছিল ক্বালবের বিদ্যা। সাহাবায়ে কেরাম হযরত রাসুল (সা.)-এর সহবতে থেকে তাঁর শিক্ষা অনুযায়ী ধ্যান-সাধনা করে ক্বালবি বিদ্যা অর্জনের মাধ্যমে আদর্শ জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন। মি‘রাজ পূর্বকালীন রাহ্মাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) দীর্ঘ ১২ বছর সাহাবিদেরকে আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগের শিক্ষা তথা ক্বালবি বিদ্যার শিক্ষা দিয়েছেন।
হযরত হাসান (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “এলেম হলো দু’প্রকার। যথা- ১। ক্বালবি এলেম, আর এ এলেমেই হচ্ছে পরম উপকারী এলেম, ২। মুখের এলেম তথা কিতাবি এলেম; আর এ এলেমই মাখলুকাতের উপর আল্লাহ্র দলিল। (তিরমিজি ও মুসতাদরাকে হাকেমের সূত্রে তাফসীরে দুররে মানছুর ২২নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “শয়তান আদম সন্তানের ক্বালব বা দিলের মাঝে অবস্থান করে। যখন সে আল্লাহ্র জিকির করে, শয়তান তখন সরে যায়। আর যখন সে (আল্লাহ্র জিকির থেকে) গাফেল হয়, তখন শয়তান তার দিলে ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা দিতে থাকে।” (বোখারীর সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১৯৯) এই শয়তান মানুষের রিপুসমূহকে কুপথে পরিচালিত করে এবং মানুষের দেহ ও মনে আধিপত্য বিস্তার করে, মানুষকে আল্লাহ্ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তখন ঐ মানুষ নিজেই শয়তানে পরিণত হয় এবং অন্য মানুষকেও কুমন্ত্রণা দিয়ে বিপথে পরিচালিত করে। অদৃশ্যমান শয়তান হলো- শয়তান প্রবৃত্তিতে প্রভাবিত নফ্সে আম্মারা। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “নিশ্চয় নফ্সে আম্মারা (মানুষের জীবাত্মা) মন্দ কাজেরই প্ররোচনা দিয়ে থাকে।” (সূরা ইউসুফ ১২: আয়াত ৫৩) সুতরাং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য ক্বালবি বিদ্যা শিক্ষা নেওয়া জরুরি। হযরত নু’মান ইবনে বশীর (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “জেনে রেখো, নিশ্চয় মানবদেহের মধ্যে একটি মাংসের টুকরো আছে, তা যখন ঠিক (পবিত্র) হয়ে যায়, তখন গোটা শরীরই ঠিক (পবিত্র) হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ (অপবিত্র) হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ (অপবিত্র) হয়ে যায়, সে মাংসের টুকরোটি হলো ক্বালব বা হৃদয়।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩; ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৯ ও ৪০, হাদিস নং ৫০)
আমরা বাহ্যিকভাবে ওজু ও গোসল করলে দেহের বাহিরের অংশ পরিষ্কার হয়। কিন্তু ক্বালব বা হৃদয় সারাদিন ওজু-গোসল করলেও পবিত্র হবে না। অর্থাৎ সমস্ত দেহ অপবিত্রই থেকে যায়। আর অপবিত্র দেহ নিয়ে নিয়ত করলে কোনো নিয়ত শুদ্ধ হবে না। নিয়ত শুদ্ধ না হলে কোনো ইবাদতও শুদ্ধ হবে না। তার অর্থ ইবাদতের পুরোটা পরিশ্রমই বিফলে যাবে। ক্বালব বা হৃদয় পবিত্র করে বিশুদ্ধ ইবাদতের জন্য অবশ্যই ক্বালবি বিদ্যা অর্জন করতে হবে। পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে বর্ণিত হয়েছে- “দুর্ভোগ তাদের জন্য, যাদের ক্বালব (হৃদয়) কঠোর, আল্লাহ্র জ্বিকির থেকে গাফেল (বিমুখ)। তারা রয়েছে প্রকাশ্য গোমরাহিতে।” (সূরা ঝুমার ৩৯: আয়াত ২২) আল্লাহ্ যাকে বিপথগামী বলেছেন সে কিতাবি বিদ্যায় যত বড়ো বিদ্বান হোক সে ইমানদার নয়। এমন ব্যক্তি নামাজে দাঁড়ালে শয়তান তার মনকে অন্যদিকে ধাবিত করে দেয়। ফলে নামাজরত অবস্থায় তার মন নানান দিকে ছুটাছুটি করে। ঐ ব্যক্তির নামাজে আল্লাহ্র দিদার লাভ হয় না। যে নামাজে মন আল্লাহ্কে ভুলে নানান দিকে ছুটাছুটি করে এমন নামাজতো শুধুই দৈহিক পরিশ্রম। উক্ত নামাজের কী ফল, তা আল্লাহ্ নিজেই পবিত্র কুরআনে বলে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “দারুণ দুর্ভোগ ঐসব নামাজির জন্য, যারা নিজেদের নামাজ সম্বন্ধে উদাসীন। আর যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে।” (সূরা মাউন ১০৭: আয়াত ৪, ৫ ও ৬) হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- “হুজুরি দিল তথা একাগ্রতাবিহীন নামাজ কবুল হয় না। [নূরুল আসরার (নূর তত্ত¡) ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫] মহান আল্লাহ্র বাণী অনুযায়ী এ ধরনের নামাজ দুর্ভোগের কারণ।
মহান আল্লাহ্ বলেছেন- “যে ব্যক্তি তার রবের সাক্ষাৎ লাভের আশা রাখে সে যেন নেক কাজ করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।” (সূরা কাহ্ফ ১৮: আয়াত ১১০) তাই সত্যিকারভাবে একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায় করতে পারলে আল্লাহ্র দিদার লাভ করা সম্ভব। সেজন্য প্রয়োজন ক্বালবি বিদ্যা। এলমুল ক্বালব শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথম হাতে খড়ি হলো ক্বালবে আল্লাহ্র জ্বিকির জারি। ক্বালবে আল্লাহ্র জিকির জারি করার জন্য মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী কামেল মোকাম্মেল মোর্শেদের হাতে বায়াত হতে হবে। অতঃপর মোর্শেদের শিক্ষা অনুযায়ী আমল ও ধ্যান সাধনা করে হৃদয়ের পাপ কালিমা দূর করে ক্বালবকে স্বচ্ছ আয়নার মতো পরিষ্কার পবিত্র করতে হবে। তখন নামাজে তার মন আর ছুটাছুটি করবে না। যখন দয়াল রাসুল (সা.)-এর প্রেম হাসিল হবে, তখন সে প্রকৃত আশেকে রাসুলে পরিণত হবে এবং তাঁর আদর্শে আদর্শবান হতে পারবে। এভাবে ক্বালবে জিকির জারি এবং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে সাধক নিজের ভিতরে আল্লাহ্র সুপ্ত নুর জাগ্রত করতে পারবে এবং নিজেকে আলোকিত করতে পারবে। ঐ পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হলে সাধক নামাজে আল্লাহ্র দিদারের মাধ্যমে পরম স্বর্গীয় শান্তি লাভ করতে পারে। ফলে সাধকের ইহকালে পরম শান্তি— এবং পরকালে মুক্তির ব্যবস্থা হয়ে যায়। তাই সঠিকভাবে ইবাদত তথা ধর্ম পালনের জন্য আমাদেরকে ক্বালবি বিদ্যায় বিদ্বান হতে হবে।
যুগশ্রেষ্ঠ মহামানব সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান আমাদেরকে ক্বালবি বিদ্যার শিক্ষা দিয়েছেন এবং এই শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে অসংখ্য আশেকে রাসুল মহান আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.)-এর দিদার লাভ করেছেন। তাঁর ওফাতের পরে বর্তমানে মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্বপ্রদানকারী ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর মানুষকে এই শিক্ষাই দিয়ে যাচ্ছেন। আসুন আমরা তাঁর সান্নিধ্য গ্রহণ করে ক্বালবি বিদ্যা অর্জনের মাধ্যমে ইহলৌকিক শান্তি ও পারলৌকিক মুক্তির ব্যবস্থা করে ধন্য হই। আমিন।
[লেখক: ইসলামি গবেষক]