জি.সি. দেব
সায়মা সাদিয়া মুনা: গোবিন্দ দেবের পূর্ণ নাম গোবিন্দ চন্দ্র পুরকায়স্থ। তাঁর পিতা ঈশ্বরচন্দ্র দেব পুরকায়স্থ, মাতার নাম শরৎসুন্দরী দেবী। তাঁর জন্ম ১৯০৭ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলার বিয়ানী বাজারের শটিতা গ্রামে। তিনি জি.সি. দেব নামেই বেশি পরিচিত। ড. দেবের পূর্বপুরুষগণ ছিলেন গুজরাটের। কিন্তু পরবর্তীতে সেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় উত্থান-পতনের জন্য তাঁরা গুজরাট ত্যাগ করে সিলেটে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
ড. দেব ১৯২৯ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজের দর্শন বিভাগ থেকে বি.এ. (সম্মান) এবং ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন জায়গায় অধ্যাপনার সুযোগ পান। অধ্যাপনার পাশাপাশি নানা ধরনের গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। ১৯৪৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগদান করেন।
জি.সি. দেব ছিলেন একজন মানবতাবাদী দার্শনিক। চিন্তা-চেতনায়, মননে তিনি গভীর মানবতার কথা পোষণ করতেন। মানবতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি ‘এক বিশ্ব ধারণা’ দিয়েছিলেন। দর্শন নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ ছাড়াও তিনি রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি ইত্যাদি বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন এবং তাঁর বিভিন্ন লেখনীতে এসবের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। জি.সি. দেব সারাজীবন মানবতার যোগসূত্রের সন্ধান করেছেন। তাঁর দর্শনকে তাই বলা হয় জীবন দর্শন। এ প্রসঙ্গে জি.সি. দেবের একটি কথা বলা যায়, “সারা জীবন দর্শনের সাথে আন্তরিক যোগ স্থাপনের চেষ্টা করে এই সত্য উপলব্ধি করেছি যে, সার্থক দর্শন মানেই জীবন দর্শন। দর্শন কথাটি তাই জীবন দর্শন কথারই একটি প্রতিশব্দ।
জি. সি. দেব একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। তিনি সমন্বয়ী জীবনদর্শনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। জীবন চলার পথে তিনি সবসময় মধ্যমপন্থা অবলম্বনের কথা বলেন। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দেশ কাল অবস্থার ভেদাভেদ না করে তিনি মানবপ্রেমের কথা বলেন। যে মানবতা হবে সকল মানুষের কল্যাণের নিরিখে। তাই তিনি উগ্রভাববাদ ও উগ্র জড়বাদ উভয়কেই বর্জন করেছেন। তাঁর চোখে এই দুটোর সমন্বয়ে যে দর্শন গঠিত হবে একমাত্র তাই হবে সকল মানুষের জন্য উত্তম দর্শন মানবিকতাবোধই হবে এর প্রধান ও মূল লক্ষ্য।
সমন্বয়ী দর্শনের বাস্তবরূপই ‘এক বিশ্ব ধারণা’। যুগে যুগে অনেক দার্শনিকই ‘এক বিশ্ব ধারণা’র কথা বলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বার্ট্রান্ড রাসেল, গৌতম বুদ্ধ, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমূখ। জি.সি. দেবও ‘এক বিশ্ব ধারণা’র কথা জোর দিয়ে বলেন। তাঁর মতে, এক বিশ্ব ধারণা হলো যেখানে এক বিশ্ব সরকার থাকবে অর্থাৎ আলাদা আলাদা কোনো জাতিসত্তা থাকবে না, থাকবে না কোনো জাতিতে-জাতিতে রেষারেষি, জাতিগত অহংকার ইত্যাদি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যেমন জার্মান জাতিসত্তার অহংকার থেকেই ইহুদি জাতির ওপর অত্যাচার চালিয়েছেন। এমন ঘটনা থেকে ড. দেব সম্পূর্ণ মানবজাতির মিলনের উপাদান খুঁজেছেন। এই উপমহাদেশে তাঁর দর্শনই সমন্বয়ী দার্শনিক ধারার স্বার্থক প্রবর্তন ঘটায়। তাঁর দর্শন সমগ্র জাতির জন্য অনুকরণীয়।
জি.সি. দেব মনে করেন তাঁর শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষাদর্শনও এক বিশ্ব ধারণা গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। কারণ তিনি এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেন, যে শিক্ষাব্যবস্থা হবে মানবিক, উদার, মুক্ত-চিন্তার আঁকর, নৈতিকতায় ভরপুর। কারণ শিক্ষাব্যবস্থাই একটি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে উদ্ভাসিত করে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় তিনি বহির্দৃষ্টিসম্পন্ন, আত্মকেন্দ্রিকতা, নীতিহীন ও মূল্যবোধের অভাব খুঁজে পান। তাই তিনি এই শিক্ষাব্যবস্থাকে অপূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা বলেন। আর এ কারণেই সম্পূর্ণ পৃথিবীব্যাপী আজ এতো নৈরাজ্য হানাহানি, সংঘাত ইত্যাদি। তাই জি.সি দেব মনে করেন শিক্ষাব্যবস্থা প্রথমেই হতে হবে মুক্ত, মানবিক ও শান্তির পথনির্দেশক। শিক্ষা-ব্যবস্থায় যতি প্রেম, সৌন্দর্য, অপার আনন্দই না থাকে তাহলে সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে অপরিপূর্ণ বলা যায়; আর এর মাধ্যমে কখনো সুন্দর জীবন গঠন সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে বলা যায় “পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে বিশ্বের ঐক্য ও মানুষের ঐক্য, এমন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যা মানুষের দৈহিক ও আত্মিক ক্ষুধা মেটায়। আর এই শিক্ষাব্যবস্থাই হবে এক বিশ্ব গড়ে তোলার মহান হাতিয়ার।
জি.সি. দেবের প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৯টি। যেগুলো তার জীবদ্দশায়ই প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: আইডিয়ালিজম অ্যান্ড প্রগ্রেস (১৯৫২), আমার জীবন দর্শন (১৯৬৭), বুদ্ধ, দি হিউমেনিস্ট (১৯৬৯) ইত্যাদি। এ সব গ্রন্থে তাঁর মানবতাবাদী দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। দর্শনে বিশিষ্ট অবদানের জন্য ১৯৬৭ সালে ড. দেবকে সম্মানসূচক ‘দর্শন সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও তিনি একুশে পদক-সহ নানা পদকে ভূষিত হন। দেশে ও বিদেশে দর্শনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু তারপরও দেশপ্রেমের প্রবল ভালোবাসা থেকে তিনি দেশত্যাগ না করে এখানে থেকে যান এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। অধ্যাপক দেবের এই হত্যাকান্ডকে ইতিহাসে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দেবের সহকর্মী স্ফট বুচার বলেন,
“He was a roly-poly, gray-haired, jovial guy. He was a very pacifistic figure, well-known and well liked in American circles. He was a political as far as I could tell”
ড. দেবের দর্শন আমাদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর এই নির্মম মৃত্যুতে আমরা তথা দর্শন পরিবারসহ সম্পূর্ণ বাংলাদেশ হারিয়েছি এক বুদ্ধিজীবীকে। তাঁর মানবতার জয় হোক পৃথিবী জুড়ে। তিনি যে স্বপ্ন লালন করে গেছেন তা বাস্তবায়িত হলে পুরো পৃথিবী সমগ্র সংঘাত ও নৃশংসতা ভুলে স্বর্গ সুখে পরিণত হবে। আমাদের দায়িত্ব তাঁর দর্শনকে লালন করে সামনে এগিয়ে যাওয়া এবং এক মানবিক বিশ্ব গঠনে কাজ করা। তাহলেই আমরা খুঁজে পাবো প্রকৃত সুখ।