কৃষি ডেস্ক: এবছর ভরা বর্ষায়ও আবহাওয়ার খেয়ালিপনা ছিল লক্ষ্যণীয়। একদিকে দক্ষিণবঙ্গে ভারি বৃষ্টি অন্যদিকে উত্তরবঙ্গে হাহাকার। এমনিতেই এ বছর বর্ষা আগমন ঘটেছে দেরিতে। তার ওপর সেভাবে বৃষ্টির দেখা নেই। দেশজুড়ে দেখা দিয়েছে পানির সংকট। তীব্র গরমে তাই প্রাণ ও প্রকৃতির নাজেহাল দশা। এর প্রভাব পড়েছে কৃষিতেও। কৃষকের কপালে তাই দুশ্চিন্তার ভাঁজ। আমন ধানের মৌসুম চলা সত্ত্বেও তৈরি করা যাচ্ছে না জমি। পিছিয়ে যাচ্ছে ধান চাষ। বৃষ্টিনির্ভর মৌসুমে এখন সেচই একমাত্র ভরসা। এতে করে বাড়বে উৎপাদন খরচ। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে চাষবাস থেকেই মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার উপক্রম হবে ভবিষ্যতে। ঝুঁকিতে পড়বে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা-এমনটাই মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, আজকের এ পরিস্থিতির জন্য আমরাই দায়ী। নিত্যদূষণে বিষিয়ে তুলেছি পৃথিবীকে। তারই ফলশ্রুতিতে প্রকৃতির এমন খামখেয়ালিপনা ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। মানুষ না পাল্টালে আগামী দিনেও এভাবেই চলবে। গত এক দশকের চিত্রও কিন্তু তাই বলছে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা প্রায় প্রতি বছরই ভাঙছে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। এতে করে পিছিয়ে যাচ্ছে দেশের শস্য ব্যবস্থাপনাও।
বছর ২০-২৫ হলো আষাঢ়ে আর বর্ষার দেখা নেই। এখন তা ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষা করতে হচ্ছে শ্রাবণের জন্য। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, জুলাইয়ে আবহাওয়ার অবস্থা ছিল অস্বাভাবিক। স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৫৮ ভাগ কম বৃষ্টি হয়েছে বর্ষার এ মাসে, আগস্টেও তাই। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে এবং বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই জুলাই ছিল উষ্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের বিশেষ কিছু পরিস্থিতির কারণে এ অবস্থা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে। তবে বিষয়টি আমাদেরও ভাবাচ্ছে বেশ। চলতি আগস্টেও স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি ঝরেছে। এমনকি মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দিন ও রাতের তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি
জলবায়ু গবেষকরা বলছেন, তথ্য-উপাত্তে দেখা যাবে মোট বৃষ্টিপাতের মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। বছর শেষে প্রায় একই পরিমাণ বৃষ্টি হয়। তবে মূল সমস্যাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে যখন হওয়া দরকার তখন হচ্ছে না। এখন করারও কিছু নেই, পরিবেশের এমন বৈরিতার সঙ্গে মিলিয়েই তৈরি করতে হবে শস্য ব্যবস্থাপনা। সেই সঙ্গে ধারণার ওপর নয়, আবহাওয়া সম্পর্কে সঠিক বার্তা দিতে হবে কৃষকদের।
দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদার অনেকটাই আসে আমন ধান থেকে। চারা রোপণের উপযুক্ত সময় শ্রাবণ। বৃষ্টির পানিতে চাষ হয় বলে উৎপাদন খরচ কম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, অন্যান্য বছর এ সময়ে আমন ধান রোপণের কাজ প্রায় শেষ হয়ে যায়। আর এ বছর পানির অভাবে চাষীরা কাজই শুরু করতে পারেননি। ‘বৃষ্টি তো হবেই-সে আশায় সেচের মাধ্যমে জমিতে চারা লাগিয়ে বিপাকে পড়েছেন উত্তরবঙ্গের অনেক কৃষক। শ্রাবণের প্রখর রোদ পানি টেনে নিচ্ছে, শুকিয়ে কাঠ জমির মাটি। তাই শুরু থেকেই বেড়ে যাচ্ছে খরচের বোঝা। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! এর মধ্যে আবার উজানীঢলে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি বন্যার পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সেই পূর্বাভাস মিলে গেলে আমন চাষে এর বেশ প্রভাব পড়বে। নিশ্চিত মুখ থুবড়ে পড়বে লক্ষ্যমাত্রা। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার আমন চাষ পিছিয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে যাবে বোরো চাষ। আলু, পেঁয়াজ বা অন্য ফসল চাষও পেছাবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের শস্য পরিকল্পনাই মার খাওয়ার আশঙ্কা প্রকট।
ধানই শুধু নয়, রুক্ষ মাটিতে তীব্র দাবদাহে শুকিয়ে যাচ্ছে ফুলের পরাগ রেণু। ফসল বাঁচাতে তাই জমিতে সেচ দিতে হচ্ছে। তাতেও লাভ হচ্ছে না তেমন। ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, খুলনা ও বাগেরহাটে উঁচু জমি কিংবা পুকুরপাড়ে প্রচুর গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষ হয়। দাম ভালো থাকায় প্রতি বছর এ সময় লাভের মুখ দেখেন কৃষক। এবার উল্টো চিত্র। আবহাওয়া সহায় হয়নি। পটোল, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, শসা, করলা, উচ্ছে, ঢেঁড়স, চাল কুমড়া, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, ডাঁটা ও লাউ-কোনো সবজিরই ফলন ভালো না। পানির অভাবে পুড়ে যাচ্ছে সব গাছ। বেড়েছে রোগ ও পোকার আক্রমণ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তীব্র তাপপ্রবাহের জন্য কম বৃষ্টি, বাতাসের গতি হ্রাস, জলীয়বাষ্পের আধিক্য, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য কমে যাওয়াকেই দায়ী করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। গত এক দশকে গ্রীষ্ম ক্রমে দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং শীতকালেও গড় তাপমাত্রা বেশি থাকছে। আবার বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণও কমে গিয়েছে আশঙ্কাজনক হারে। অতিরিক্ত গরমে মেঘ পুঞ্জীভূত হতে পারছে না। মেঘে যে পানি থাকে তা বৃষ্টি হয়ে নামার আগেই গরম বাতাসের ধাক্কায় বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। আবার তীব্র গরম বাতাসের স্বাভাবিক গতি প্রবাহেও পরিবর্তন এসেছে। তাই বৃষ্টি নিয়ে এত হা-হুতাশ।
এদিকে উৎপাদন কম হলে দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করতে হয় আমদানির মাধ্যমে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাল আসে প্রতিবেশী ভারতসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে। কিন্তু ভারতের যেসব এলাকায় ধান বেশি হয়, সে অঞ্চলগুলোতেও এবার বৃষ্টি কম হয়েছে। চীন পুড়ছে তাপদাহে এবং ভিয়েতনামেও বৈরী আবহাওয়ার ফলে সার্বিকভাবে উৎপাদন কমবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদনকারী এসব দেশে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, ভারত, চীন ও বাংলাদেশসহ কয়েকটি প্রধান ধান উৎপাদনকারী দেশের আবহাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অবস্থার উন্নতি না হলে উৎপাদন কমে যেতে পারে।