হিমোফিলিয়া: যে রোগে রক্তক্ষরণ সহজে বন্ধ হয় না

হিমোফিলিয়া: যে রোগে রক্তক্ষরণ সহজে বন্ধ হয় না

ডা. মো. তারেক ইমতিয়াজ (জয়)

হিমোফিলিয়া কী?

শরীরের কোথাও কেটে গেলে স্বভাবতই সেখানে রক্তক্ষরণ হয়। তবে সেই রক্তপাত বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, সাধারণত কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার এই প্রক্রিয়ায় ১২টি ভিন্ন ভিন্ন রক্তের উপাদান একত্রে কাজ করে। এগুলোকে ক্লটিং ফ্যাক্টর (Clotting factor) বলে। এর মধ্যে কোনো একটি ক্লটিং ফ্যাক্টর যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি না হয় অথবা সঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে রক্তক্ষরণ সহজে বন্ধ হয় না।

রক্তের আট নম্বর এবং নয় নম্বর ক্লটিং ফ্যাক্টর এর ঘাটতির জন্য যখন শরীরে রক্ত জমাট বাঁধায় সমস্যা হয় তখন তাকে বলে ‘হিমোফিলিয়া’। যদি আট নম্বর ক্লটিং ফ্যাক্টরের ঘাটতির জন্য রোগটি হয়ে থাকে, তাকে বলা হয় ‘হিমোফিলিয়া এ’ এবং যদি নয় নম্বর ক্লটিং ফ্যাক্টরের ঘাটতির জন্য রোগটি হয়ে থাকে, তাহলে বলা হয় ‘হিমোফিলিয়া বি’। তবে বিশ্বে হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৮৫ জন ‘হিমোফিলিয়া এ’ তে আক্রান্ত।

গে্রট ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার বংশধরদের মাঝে হিমোফিলিয়া রোগটি প্রথম ধরা পরে। রানী ভিক্টোরিয়ার কয়েকজন কন্যা সন্তান এই রোগের বাহক ছিলেন। তাদের যখন অন্য দেশের রাজপরিবারে বিয়ে হয়, তখন এই রোগ তাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণেই এ রোগকে রাজকীয় রোগ বলা হয়।

এই রোগটি কাদের হয়?

হিমোফিলিয়া এক ধরনের রক্তক্ষরণজনিত বংশগত রোগ। আমরা জানি পুরষ এবং নারীর প্রত্যেকেরই এক জোড়া লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম রযেছে। নারীর ক্ষেত্রে এই লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম দু’টি হলো ‘XX’ এবং পুরষের ক্ষেত্রে এই লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম দু’টি হলো ‘XY’। আট এবং নয় নম্বর ক্লটিং ফ্যাক্টর তৈরির জন্য নির্ধারিত জিন থাকে এই X ক্রোমোজমে। এই বিশেষ জিনে যদি মিউটেশন হয় অর্থাৎ কোনো কারণে যদি এই জিনের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় তখন এই নির্দিষ্ট জিন শরীরের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আট অথবা নয় নম্বর ক্লটিং ফ্যাক্টর তৈরি করতে পারে না। ফলে সেক্ষেত্রে এই হিমোফিলিয়া রোগটির উপসর্গ দেখা দেয়। নারীদের দুইটি X ক্রোমোজোম থাকে। ফলে নারীদের একটি X ক্রোমোজোমে যদি ত্রুটিযুক্ত জিন থাকে তাহলে অপর X ক্রোমোজোম ভালো থাকায় রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না, তবে তাদের একটি X ক্রোমোজোমে সেই ত্রুটিযুক্ত জিন থাকার জন্য সেই নারী এই রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু পুরষের যেহেতু X ক্রোমোজোম যেহেতু একটিই থাকে এবং সেই X ক্রোমোজমে এই ত্রুটিযুক্ত জিন থাকলে সেক্ষেত্রে পুরষের এই হিমোফিলিয়া রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ফলে বংশগত হলেও রোগটিতে সাধারণত পুরষরাই আক্রান্ত হয়। নারীরা সাধারণত এ রোগে আক্রান্ত হয় না। তবে নারীরা কেবলমাত্র রোগটির বাহক হিসেবে কাজ করে। এজন্য রোগীর বাবা-মা এর কাছ থেকে রোগের ইতিহাস নিলে দেখা যায় যে পরিবারে আক্রান্ত ছেলে শিশুর হয়তো আরেকটি ভাই এই রোগে আক্রান্ত বা তার কোনো মামা এই রোগে আক্রান্ত ছিল। কিন্তু আক্রান্ত ছেলে শিশুর মা, খালা বা বোন কারও এই রোগের কোনো ইতিহাস নেই।

উপসর্গ

অনেক ভাবেই এই রোগের উপসর্গ প্রকাশ পেতে পারে। সাধারণত এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হলো আক্রান্ত শিশুর ত্বকের নিচে একা একা অথবা আঘাতজনিত কারণে রক্তক্ষরণ হয়ে ত্বকে কালচে দাগ পরে। শিশুর মাংসপেশিতে বা অস্থিসন্ধিতে আঘাতজনিত কারণে বা কখনো একা একাই রক্তক্ষরণ হতে পারে। ফলে মাংসপেশির কিছু অংশ ফুলে যায় বা অস্থিসন্ধিতে রক্তক্ষরণের কারণে অস্থিসন্ধি ফুলে যায়। অস্থিসন্ধিতে এরকম বারবার রক্তক্ষরণ হলে সেই অস্থিসন্ধির ক্ষতি হতে পারে। নবজাতক অবস্থায় নাড়ি কাটার পরে রক্ত বন্ধ হতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। দাঁত উঠানোর সময় অথবা খৎনা করার পরে দীর্ঘ সময় রক্তক্ষরণ অব্যাহত থাকতে পারে। তবে এই রোগের সবচেয়ে বিপদজনক দিক হলো এই রোগে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে যা রোগী মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

রোগ নির্ণয়

যে দু’টি ক্লটিং ফ্যাক্টরের ঘাটতির জন্য এই রোগটি হয় সেই দু’টি ক্লটিং ফ্যাক্টর অর্থাৎ রক্তে আট ও নয় নং ক্লটিং ফ্যাক্টর-এর মাত্রা পরীক্ষা করে রোগটির ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়।

চিকিৎসা

হিমোফিলিয়া পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য কোনো রোগ নয়। তবে আক্রান্ত শিশু সময়মত সঠিক চিকিৎসা পেলে সুস্থ ও সক্রিয় জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়। রক্তপাত বন্ধ করা ও রক্তপাতের হার কমানোই চিকিৎসার মূল লক্ষ্য। সাধারণত ক্লটিং ফ্যাক্টর ৮ বা ৯ শিরাপথে প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। পাশাপাশি শরীরে কোথাও কেটে গেলে তা ব্যান্ডেজ দিয়ে চেপে ধরতে হবে, আক্রান্ত স্থান নড়াচড়া কম করতে হবে। রক্তপাত বন্ধের জন্য আক্রান্ত স্থানে বরফ দেওয়া যেতে পারে।

সতর্কতা

হিমোফিলিয়া আক্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। আঘাত পেতে পারে এরকম কোনো খেলাধুলা যেমন: ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলায় শিশুকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যাবে না। স্কুলে শিক্ষকদেরকে আগে থেকেই শিশুর এই রোগের ব্যাপারে সতর্ক করতে হবে যেন তারা শিশুকে শাসন করতে গিয়ে প্রহার না করে। ছেলে শিশুকে খতনা করানো যাবে না। দাঁত উঠানো অথবা ছোট-বড়ো কোনো অপারেশনের প্রয়োজন পড়লে চিকিৎসককে শিশুর এই রোগের ব্যাপারে আগেই অবহিত করতে হবে। এই রোগে আক্রান্ত শিশুর মাংসপেশিতে টিকা বা কোনো ইনজেকশন দেওয়া যাবে না। শিশুকে অ‍্যাসপিরিন বা ব্যথানাশক কোনো ঔষধ সেবন করানো যাবে না।

[লেখক: এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য); সহকারী রেজিস্ট্রার, শিশু কার্ডিওলজি বিভাগ, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।]

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *