মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- “আর তিনি মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি দিয়ে, তারপর তার বংশধরকে সৃষ্টি করেন দুর্বল পানির নির্যাস থেকে। অতঃপর তিনি তাকে সুঠাম করেন এবং তাতে নিজের তরফ থেকে রূহ ফুঁকে দেন। আর তোমাদেরকে দান করেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ। কিন্তু তোমরা খুব কমই শোকর করো। (সূরা আস সাজদাহ ৩২: আয়াত ৭ থেকে ৯)
মহান রাব্বুল আলামিনের এ বাণী মোবারকে বিষয়টি সুস্পষ্ট, মানুষের দুটি অংশ রয়েছে। একটি বাহ্যিক দেহ, যার অস্তিত্ব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। অপরটি হলো অভ্যন্তরীণ, যা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির বাইরে। আর এটির নাম রূহ বা আত্মা। দেহের মাঝে এই আত্মা রয়েছে বলেই দেহের স্পন্দন লক্ষ্য করা যায়। দেহ স্থূল জগতের উপাদানে গঠিত। এটি মাটি, পানি, আগুন ও বাতাস এই চারটি উপাদানের দ্বারা তৈরি। কিন্তু রূহ বা আত্মা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জগত আলমে আমরের জিনিস। রূহ মূলত মানবদেহে আল্লাহর কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও নিয়ামক শক্তি। এক ফোঁটা পানি যেমন মহাসমুদ্রের অথৈ জলরাশির অংশ তদ্রুপ প্রতিটি মানুষের মাঝে ফুঁকে দেওয়া ‘রূহ’ নূরময় সত্তা আল্লাহরই সত্তা বিশেষ। রূহ মানবদেহে মহান রাব্বুল আলামিনের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে রূহরূপে মহান আল্লাহ নিজেই প্রতিটি মানুষের অন্তরে বিরাজিত থেকে মানবদেহের চালিকা শক্তি হয়ে কাজ করছেন এবং আপন রহমত দ্বারা মানুষকে বেষ্টন করে রেখেছেন। এজন্য রূহ বা আত্মা চিরকালই একটি রহস্যের বিষয় বলে গণ্য।
মহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেন- “তারা আপনাকে রূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে, হে রাসুল (সা.)! আপনি বলুন- রূহ আমার প্রতিপালকের একটি নির্দেশ। আর এ সম্পর্কে তোমাদেরকে সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে।” (সূরা বনী ইসরাঈল ১৭: আয়াত ৮৫)
মানুষ স্থুল জগতের জ্ঞানবিজ্ঞানে যত বেশি উৎকর্ষ সাধন করুক না কেন, আত্মা সম্পর্কে তার জ্ঞান অতি সীমিত। আত্মা একটি একক শক্তি বলেই তার রূপ ও আকৃতি রয়েছে। বাহ্যিক চোখ দিয়ে তার অস্তিত্ব দেখা না গেলেও, অন্তর চক্ষুওয়ালা সাধকের কাছে আত্মার রূপ, আকৃতি ও গতি ধরা পড়ে। এ প্রসঙ্গে হযরত মুজাহিদ (রহ.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- “রূহ সৃষ্টিজগতভাবে আদম সুরতের। সে খায় এবং পান করে (আর রূহের পানাহার হচ্ছে ফায়েজ)।” (তাফসীরে তাবারী ৩০নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২ এবং তাফসীরে দুররে মানছুর ৩০নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৯৯)
মানুষের আত্মাকে দু’টি অংশে বিভক্ত করা যায়। যথা- (১) জীবাত্মা ও (২) পরমাত্মা।
জীবাত্মা অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় দেহের সাথে সম্পর্ক রাখে। পক্ষান্তরে পরমাত্মা আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত। জীবাত্মার কারণে ষড়রিপু দেহের মাঝে সক্রিয় হয়। অপরদিকে পরমাত্মার কারণে মানুষ আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট হয় এবং একাগ্র চেষ্টার মাধ্যমে নিজের ভিতরে আল্লাহর চরিত্র বিকশিত করতে পারে। রিপু যখন কুপথে ধাবিত হয়, তখন জীবাত্মা শক্তিশালী হয়, আর পরমাত্মা নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং মানুষ আল্লাহকে ভুলে পাপের পথে ধাবিত হয়।
সুমহান আল্লাহ্ ফরমান- “আর আপনি তাদের সে লোকের বৃত্তান্ত শুনিয়ে দিন, যাকে আমি আমার নিদর্শনাবলি দান করেছিলাম; কিন্তু সে তা বর্জন করে বেরিয়ে গেলো এবং শয়তান তার পেছনে লেগে গেলো, ফলে সে পথভ্রষ্টদের শামিল হয়ে গেলো। অবশ্য আমি চাইতাম, তবে তাকে সে নিদর্শনাবলির বদৌলতে উচ্চ মর্যাদা দান করতাম, কিন্তু সে দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে লাগল। ফলে তার অবস্থা কুকুরের মতো; যদি তুমি তাকে আক্রমণ করো, তবুও সে হাঁপাতে থাকে, অথবা যদি তুমি তাকে ছেড়ে দাও, তবুও সে হাঁপাতে থাকে। এ হলো সে সকল লোকের উদাহরণ, যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে। অতএব আপনি এসব বৃত্তান্ত বর্ণনা করুন, যেন তারা চিন্তা করে।” (সূরা আল আ‘রাফ ৭: আয়াত ১৭৫ ও ১৭৬)
সুতরাং ষড়রিপু মানুষকে পাপাসক্ত করে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, রিপুকে সুপথে পরিচালিত ও মানবাত্মাকে শক্তিশালী করে আল্লাহর পরিচয় লাভের জন্য অলী-আল্লাহর তাওয়াজ্জোহর প্রয়োজন।