মহান আল্লাহর অপূর্ব শিল্পকর্ম মানবদেহ। পবিত্র কুরআনে তিনি নিজেই তাঁর এই শিল্পকর্মের সৌন্দর্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম গঠনে।’ (সূরা তিন: আয়াত ৪)
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দৈহিক অবয়ব এবং আকার-আকৃতি, আচার-ব্যবহার ও মানুষ্যত্বের মাধ্যমে অন্য সব প্রাণী অপেক্ষা সুন্দরতম করেছেন। আকার-আকৃতির বাইরেও আল্লাহ তায়ালা তাকে জ্ঞানী, শক্তিবান, বক্তা, শ্রোতা, স্রষ্টা, কুশলী ও প্রজ্ঞাবান করেছেন। (ফাতহুল কাদির)
তিনি এটিকে যেমন নিপুণভাবে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি এটি পরিচালিত করছেন সুনিপুণভাবে। এতে তিনি তাঁর সৃষ্টির অসংখ্য অগণিত নিদর্শন রেখে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘সুনিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য জমিনে অনেক নিদর্শন রয়েছে এবং তোমাদের মধ্যেও। তোমরা কি অনুধাবন করবে না?’ (সূরা জারিয়াত: আয়াত ২০-২১) যেমন মানুষের চোখের কথাই ধরা যাক। চোখ আল্লাহর নিপুণ কারিগরির একটা নিদর্শন। কোনো বস্তু দেখার জন্য মুহূর্তের মধ্যে আমাদের চোখ ও মস্তিষ্কে কত কিছু ঘটে যায়, সেটা অনুমানের অতীত। আমাদের চোখ ঠিকভাবে কাজ করার জন্য তাতে ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় ২০ লাখ ক্ষুদ্র পার্টস। আমাদের চোখের গঠন এতটাই জটিল যে সেটা মাঝেমধ্যে কল্পনাকে হার মানায়। চোখের কার্যপদ্ধতি অনেকটা ক্যামেরার পদ্ধতির মতোই। বলা যায় চোখই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ক্যামেরা। আধুনিক যুগের ক্যামেরার সঙ্গে চোখের তুলনা করতে গেলে দেখা যায়, মানুষের চোখ ৫৭৬ মেগাপিক্সেল। এর ফলে আমরা চোখ দিয়ে প্রায় এক কোটি রং আলাদাভাবে দেখতে পাই। চোখের পাতা কাজ করে ক্যামেরার শাটারের মতো। চোখের ভেতরে আছে স্থিতিস্থাপক লেন্স, যা দর্শনীয় বস্তুকে ফোকাস করে এবং তারপর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে একসময় তা আমরা দেখতে পাই। এই প্রক্রিয়াকরণ চলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই।
এরপর নাক মহান আল্লাহ প্রদত্ত এমন একটি নিয়ামত, যা দিয়ে শ্বাস নেওয়া স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। এতে সরাসরি মস্তিষ্কে অক্সিজেন জোগানের কারণে মস্তিষ্কের সক্রিয়তা বাড়ে। পাশাপাশি নাক আমাদের শারীরিক প্রতিরক্ষার সম্মুখ সৈনিক হিসেবে কাজ করে। ঘ্রাণ থেকেও যেমন আমরা সতর্ক হই, তেমনি নাক অনেক দূষণ থেকে আমাদের রক্ষা করে। নাক অনেকটা ফিল্টারের মতো কাজ করে। ধুলা, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসসহ অনেক কিছুই ফিল্টার করে ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ করে। এভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে নাক। আর নাক দিয়ে শ্বাস নিলে রক্তে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ে। আমরা প্রতিদিন ২৫ হাজার ৯২০ বার শ্বাস নিই। শুধু নাক নিয়ে চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে মহান আল্লাহ আমাদের কত বড় বড় নিয়ামতে সমৃদ্ধ করে রেখেছেন।
মানুষের মস্তিষ্কে আছে ১০০ বিলিয়নেরও বেশি নিউরন বা নার্ভ সেল। একটি গমের দানার সমপরিমাণ মস্তিষ্ক টিস্যুতে এক লাখের মতো নিউরন থাকে, যেগুলো পরস্পরের সঙ্গে এক বিলিয়ন বন্ধন তৈরি করে। মস্তিষ্কে প্রায় ১০ হাজার রকমের নিউরন রয়েছে। মস্তিষ্কের আদেশ এসব নিউরনের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের আকারে পৌঁছে। এসব তরঙ্গের গতি ঘণ্টায় ৪০০ কিলোমিটার বা তারও বেশি। প্রতিদিন মস্তিষ্কে ১২ থেকে ২৫ ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। লো-ভোল্টেজের এলইডি জ্বালানোর জন্য যথেষ্ট। আর শরীরের যেকোনো অঙ্গের চেয়ে মস্তিষ্কে অনেক বেশি পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়। আমরা শরীরের প্রয়োজনে যে খাবার খাই, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগই খরচ হয় মস্তিষ্কের শক্তি উৎপাদনের পেছনে। এই খাদ্য ও অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১০৪০-৮০ লিটার রক্ত পরিবাহিত হয় ২৪ ঘণ্টায়। মজার কথা হলো, মস্তিষ্কে ২২ লাখ সেল আছে। মানুষ তার মাত্র ৩ শতাংশ ব্যবহার করে। খুব বেশি মেধাবীরাও ১০ থেকে ১১ শতাংশের বেশি ব্যবহার করে না।
এমনিভাবে হাতের আঙুলের মধ্যেও মহান আল্লাহ তাঁর অসীম শক্তির চিহ্ন রেখে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, ‘হ্যাঁ, আমি তার আঙুলের অগ্রভাগসমূহও পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম। ’ (সূরা কিয়ামাহ: আয়াত ৪)
মহান আল্লাহ ওই আয়াতে ইঙ্গিত করেছেন, মানুষের আঙুলের অগ্রভাগে তিনি সূক্ষ্ম কোনো রহস্য রেখেছেন, যা তিনি মানুষের পুনরুত্থানের সময়ও পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম। তা হলো আঙুলের ছাপ।
১৮৮০ সালে ইংল্যান্ডে স্যার ফ্রান্সিস গোল্ট আবিষ্কার করেন, পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি পাওয়া যাবে না, যার আঙুলের ছাপ অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে হুবহু মিলে যবে। প্রত্যেক মানুষকে শনাক্ত করার জন্য তার আঙুলের ছাপই যথেষ্ট। বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন অপরাধী শনাক্ত হয়ে যায় হাতের এই আঙুলের ছাপের মাধ্যমেই। অনেকটা হাতের ছাপই বলে দেয়, অপরাধী কে হতে পারে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘আজ আমি তাদের মুখে মোহর মেরে দেব এবং তাদের হাত আমার সঙ্গে কথা বলবে ও তাদের পা সে সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে, যা তারা অর্জন করত।’ (সূরা ইয়াসিন: আয়াত ৬৫)
কুরআনের এই আয়াতের কিছুটা ব্যাখ্যা আমরা দুনিয়াতে পেয়ে গেছি। আখিরাতের এর রূপ কতটা অত্যাধুনিক হবে, তা আল্লাহই ভালো জানেন। শুধু তা-ই নয়, বর্তমানে এমন প্রযুক্তিও বের হয়ে গেছে, যা দিয়ে মানুষের হাতে আংটি পরিয়ে তার মন-মেজাজ, শারীরিক অবস্থা অনুমান করা যায়।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে পাওয়া যায়, বর্তমানে একটি আংটি বাজারে আছে, যা ব্যবহারকারীর মানসিক অবস্থা বায়োমেট্রিক সেন্সর এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে শনাক্ত করতে পারে। ইডিএ (ইলেক্ট্রোডারমাল অ্যাকটিভিটি) সেন্সরযুক্ত এ স্মার্ট আংটি আঙুলের চামড়ার স্নায়ুতন্ত্র বিশ্লেষণ করে ব্যবহারকারীর মেজাজ কেমন তা জানতে পারে। শুধু তা-ই নয়, অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীকে শান্ত বা সতর্ক হওয়ার পরামর্শও দেয়।
বোঝা যাচ্ছে মানুষের চামড়ায় বিচরণকারী যেসব কোষগুলো মহান আল্লাহ নিয়োজিত রেখেছেন, তাদের মধ্যেও মহান আল্লাহর অগণিত নিদর্শন লুকিয়ে আছে। এগুলোর আচরণ দিয়ে যদি মানুষ অন্য মানুষের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে, তাহলে যিনি এগুলো সব সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাদের সমস্ত তথ্য কতটা গভীরভাবে জানেন! হয়তো এসব সূক্ষ্ম নিদর্শনগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেই মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি শিগগিরই তাদের জন্য আমার নিদর্শনাবলি ব্যক্ত করব বিশ্বজগতে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে। ফলে তাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে ওটাই সত্য। এটা কি যথেষ্ট নয় যে তোমার রব সব বিষয়ে অবহিত?’ (সূরা ফুসসিলাত: আয়াত ৫৩)
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর দেওয়া অমূল্য নিয়ামতগুলোর শুকরিয়া জ্ঞাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন