মো. আবদুল কাইয়ুম অভি
নারী অধিকার বলতে বোঝায় এক ধরনের স্বাধীনতা, যা সকল বয়সের নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ অধিকার হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক, আইনানুগ, আঞ্চলিক সংস্কৃতি দ্বারা সিদ্ধ, অথবা কোনো সমাজের আচরণের বহিঃপ্রকাশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর এই অধিকারকে অস্বীকার করতে দেখা যায়। বিভিন্ন দেশে এ অধিকারের বিভিন্ন রকম সংজ্ঞা ও পার্থক্য দেখা যায়। কারণ, এটি পুরুষের অধিকার থেকে ভিন্ন। এ অধিকারের পক্ষে আন্দোলনকারীদের দাবি এই যে, নারী অধিকার প্রচলনের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দুর্বলতা রয়েছে।
২০১৫ সালের ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- “নারীর ক্ষমতায়ন মানবতার উন্নয়ন”। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নারী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের ভাবা উচিত যে, দু’চাকা বিশিষ্ট গাড়ির একটি চাকা যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে গাড়িটি চলবে কি করে? নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। উভয়ের শ্রমে-ঘামে, মেধা-মননে আজকের সভ্যতা এ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”
প্রাচীন যুগে নারীদের কোনো মূল্যই ছিল না। নারীদের কাজ ছিল কেবল সন্তান উৎপাদন করা- বিশেষ করে পুত্র সন্তান। প্রাচীন ভারতে কন্যা হলে তাকে মাটিতে পুতে রাখা হতো। কোনো কোনো জায়গায় কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাকে অভিশাপ মনে করে হত্যা করা হতো। নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এক কথায় প্রাচীনযুগ নারীদের অভিশাপের যুগ ছিল। মধ্যযুগে এসেও নারীর উপর নির্যাতন বন্ধ হয়নি। নারীদের বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়। তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সব ধরনের অধিকার থেকে বিরত রাখা হয়। আধুনিক এসে নারীর রাজনৈতিক সব ধরনের অধিকার থেকে বিরত রাখা হয়। আধুনিক যুগে এসে নারীরা কিছুটা সচেতন হয় এবং তাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন শুরু করে। যার ফলে নারী নির্যাতন অনেকাংশ কমে যায়। কিন্তু তাদের অধিকার পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
নারী অধিকার আন্দোলন
ফ্রান্তে সর্বপ্রথম নারী অধিকার আন্দোলন শুরু হয়। ১৮৮০ সালে ফ্রান্সের কিছু বিবেকমান পুরুষদের দ্বারা এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল। এরপর ১৮৮০ সালে যুক্তরাজ্যে এবং ১৯১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এই আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটে। বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এই শতকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন হয়েছে। শুধুমাত্র ছাত্রীরা নয়, ছাত্ররাও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছে। নারী অধিকার আন্দোলনকারীরা নারীর আইনগত অধিকার দৈহিক স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষার অধিকার, পারিবারিক ও প্রজনন অধিকার, শারীরিক-মানসিক হয়রানি ও নিগ্রহ থেকে নারী এবং কিশোরীর নিরাপত্তা, চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্বাধীন অধিকার এবং শিক্ষার সকল স্তরে ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব দেয়। যেখানে নারীর প্রতি বৈষম্য বিদ্যমান, নারী আন্দোলনকারীরা সেসব জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্যের প্রতি গুরুত্ব দেয়।
নারী অধিকার আন্দোলন জাতিসংঘ কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। ১৯৭৫ সাল থেকে ধারাবাহিকতার আন্তর্জাতিকভাবে সম্মেলন শুরু হয় এবং এ বছরেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৫ সালে চীনের বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব নারী সম্মেলনে ‘পিএফএ’ নামে কর্মপন্থা স্বাক্ষরিত হয়, যাতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ “জেল্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন” -এর লক্ষ্যে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
নারী অধিকার সম্পর্কিত আইন
নারীর সুষ্ঠু অধিকার নিশ্চিত এবং নির্যাতন প্রতিরোধে বাংলাদেশের সংবিধানে কিছু আইন প্রণীত হয়েছে আইনগুলো হলো- মুসলিম বিবাহ ও তালাক আইন ১৯৭৪, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০, যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০, এসিড অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২, পারিবারিক সহিংসতা আইন ২০১০ ইত্যাদি।
নারীর অধিকার: আইনে আছে সমাজে নেই
নারী অধিকার বাস্তবায়নে বাংলাদেশে অনেক আইন ও নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু আইনগুলো বাস্তবায়নের হার কম থাকায় যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, এসিড সন্ত্রাসের শিকার, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, সম্পত্তিতে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন নারীরা। নারী ও শিশু নির্যাতন আদালত, পারিবারিক আদালত এবং ফৌজদারি আদালতে নারী সংক্রান্ত বিষয়ে কয়েক লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বছরের পর বছর এসব মামলার নিষ্পত্তিতে না হওয়ায় নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেকে সঠিক বিচার না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। যার ফলে অপরাধীদের সাহস দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নির্যাতনও বেড়ে চলছে।
নারী নির্যাতনে ক্রমান্বয়ে চক্রান্তরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে দ্রুত নির্যাতন বাড়লে বর্তমানে সমাজব্যবস্থা প্রাচীন যুগে ফিরে যেতে বাধ্য হবে। বিগত বছরগুলোতে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাবে কীভাবে নারী নির্যাতন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুলিশ সদরদপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১১ সালে সারা দেশে ৩,৩৩৪টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। ২০১২ সালে ৪,০৯৮টি, ২০১৩ সালে ৪,৭৭৭টি, ২০১৪ সালে ৫,১৪২টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে এবং চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫ হাজারেরও বেশি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। নির্যাতনের মাত্রা এতই তীব্রতর হয়ে গেছে যে, অপরাধীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এলাকায় যৌন হয়রানির মতো অপরাধ করে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে।
নারীর ক্ষমতায়ন কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেলও তা তৃণমূল পর্যায়ে এসে পৌছায়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে আসলেও উচ্চপর্যায়ের কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। এ বিষয়ে সাবেক মহিলা আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি ফাহিমা নাসরিন মুন্নি বলেন- ‘রাষ্ট্রই প্রথম নারীদের বঞ্চিত হয়েছে। কেননা বাজেট নারীদের জন্য কম বরাদ্দ ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করেছে।’ এছাড়া স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত কোনো শাসকরেগাষ্ঠী কখনো বলে নি যে, নারীর নিরাপত্তা একটি জাতীয় ইস্যু।
নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ হলো নির্যাতনকারীর শাস্তি না হওয়া। তাছাড়া আমাদের দেশের নারী আন্দোলনে বিশেষ করে নারীর অংশগ্রহণ করছেন না। দেখা যায়, তারা নিজেরা শিক্ষা পাচ্ছেন, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছেন। তাই অন্যের অধিকার বিশেষ করে দরিদ্র কিশোরীর অধিকার লঙ্ঘন হলে তারা কিছু বলছেন না তারা নীরব দর্শকের মতো আচরণ করছেন। পরিতাপের বিষয় হলো এই শিক্ষিত মানুষেরা তাদের সহকর্মী বা প্রতিবেশি মেয়েটিও কোনো সহিংসতার শিকার হলে মাঠে নামছেন না।
আমাদের দেশের অনেক সভ্য নাগরিক বলেন যে, নারীরা তাদের অর্ধনগ্ন বা প্রায় নগ্ন পোশাকের জন্য অথবা তাদের আচরণের জন্য যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের একটি উদাহরণ দেখা যায়। মুষ্টিযোদ্ধা মাইক টাইসন যখন পৃথিবী জুড়ে খ্যাতি লাভ করেন তখন এক তরুনী জোর করে তার হোটেলে প্রবেশ করেন এবং তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করেন। যার ফলে টাইসন তাকে ধর্ষণ করেন। তরুণীটি পরে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করলে বিচারক এই মর্মে টাইসনের বিরুদ্ধে রায় দেন। যে, ‘কোনো নারী বিবসনা হলেই তাকে ধর্ষণ করার অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি। মেয়েটি তার হোটেলে জোর করে প্রবেশ করেছিল বা তাকে উত্যক্ত করেছিল বলে সে অপরাধী। এ জন্য কোর্ট তাকে সাজা দেবে, কিন্তু টাইসন তাকে এ জন্য ধর্ষণ করতে পারেন না।’ দেশে দ্রুত বিচার হলে এবং মামলার রায় দ্রুত কার্যকর হলেই নারী নির্যাতনের হার শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো নারী নির্যাতন সংক্রান্ত মামলাগুলো যেখানে ১০০ দিনের মধ্যে বিচার হওয়ার কথা সেখানে ৫-১০ বছর লেগে যাচ্ছে। ফল স্বরূপ মামলা হলেও বিচার নিশ্চিত হচ্ছে না।
নারী অধিকার বাস্তবায়ন
দীর্ঘদিন যাবত নারীরা তাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আন্দোলন করে আসছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু আইন প্রণয়নও করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও নারীর অধিকার গুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তবে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নারীর অধিকার বাস্তবায়ন সম্ভব। এমন কিছু পদক্ষেপ এখানে উল্লেখ করা হলো-
ক. নারীর প্রতি যে কোনো ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহার করা।
খ. নারী নির্যাতনের আইনগুলো সমাজে যথাযথভাবে প্রচলন করা এবং মামলার রায়গুলো দ্রুত কার্যকর করা।
গ. সম-অধিকারের পাশাপাশি যোগ্যতা, শক্তি ও সামর্থ্যরে ভিত্তিতে অধিকার প্রদান করা। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হলে স্ত্রী সন্তানের ৮০ ভাগ অধিকার দাবি করতে পারে। আবার সন্তানের ভরণ-পোষণের জন্য ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত স্বামীকে ব্যয়ভার বহন করতে হবে নতুবা স্ত্রী কোর্টে মামলা করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে যদি সম-অধিকার প্রয়োগ করা হয় তাহলে নারী বিপদে পড়বে এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। তাই সম-অধিকারের পাশাপাশি যোগ্যতা, সুযোগ, শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী অধিকার প্রদানের ব্যবস্থাও করা দরকার।
ঘ. পুরুষ কর্তৃক নারীকে শাসন করার মনোভাব পরিহার করা। কাউকে অধীনতা বা দাসত্বে আবদ্ধ করা যাবে না। সকল প্রকার ক্রীতদাস প্রথা এবং দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ করতে হবে।
ঙ. পুরুষের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারগুলো প্রয়োগ ও ভোগে নারীকে নিশ্চয়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে এবং নারীর পূর্ণ উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নসহ সব উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
চ. নারীকে নিজ অধিকার সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে এবং নিজের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
ছ. সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাদের বিবেক এবং বুদ্ধি আছে। সুতরাং একের প্রতি অন্যের ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ করা উচিত।
জ. আইনি সহায়তার নারী নির্যাতনের যতটা বন্ধ হয়েছে তার চেয়ে বেড়েছে নির্যাতনের নানা কৌশল। তাই আইনি প্রক্রিয়ায় পাশাপাশি নৈতিক ও মানবিক বোধ জাগ্রত করা উচিত।
ট্রেন ছাড়া রেললাইনের কোনো মূল্য নেই, তেমনিভাবে রেললাইন ছাড়া ট্রেন মূল্যহীন। দুই পাশে দুটি লোহা বসালেই রেললাইন হয় না। তার সাথে পাথর, সিমেন্ট, সঠিক দূরত্ব প্রভৃতির প্রয়োজন হয়। তেমনিভাবে ট্রেনও কয়েকটি জিনিসের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে। যার ফলে ট্রেন ও রেললাইন দুটো সচল থাকে। ঠিক তেমনিভাবে নারী-পুরুষ একজন অন্যজন ছাড়া মুল্যহীন। আর উভয়ের পরিপূর্ণ অধিকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুষ্ঠু, সুন্দর ও সমৃদ্ধময় সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব।