বাণিজ্য ডেস্ক: দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার বাংলাদেশকে অতিরিক্ত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ করতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। পেট্রোবাংলা এই তথ্য জানিয়েছে।
বর্তমানে কাতার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশকে প্রতিবছর ২.৫ মিলিয়ন টন (এমপিটিএ) এবং ওমান প্রতিবছর এক মিলিয়ন টন এলএনজি সরবরাহ করছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ কাতারের কাছে আরো দুই মিলিয়ন টন এলএনজি কেনার প্রস্তাব দিয়েছিল। দেশটি আগামী ২০২৫ সাল থেকে বাড়তি এলএনজি সরবরাহ করার সম্মতি দিয়েছে।
বাংলাদেশ এত দিন বাড়তি এলএনজি স্পট মার্কেট বা খোলাবাজার থেকে কিনে আসছিল। কিন্তু গত বছর থেকে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম বেড়ে যায়। এতে বাংলাদেশকে বেশি দামে এলএনজি কিনতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সরকারকে সতর্ক করে আসছিলেন। শেষ পর্যন্ত ব্যয় সামাল দিতে না পেরে সরকার গত জুলাই মাস থেকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে। তাতে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। গ্যাসসংকটে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। আবাসিক, সিএনজি স্টেশন ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। এটা শিল্প উৎপাদনে বড় প্রভাব ফেলছে।
এ অবস্থায় জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাতার থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বাড়তি এলএনজি কেনার বিষয়টি দেশের জন্য স্বস্তির খবর। উচ্চমূল্যে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। কাতার বিশ্বব্যাপী এলএনজি সরবরাহকারী বড় দেশ। তাদের গ্যাসের প্রতি ইউরোপের দেশগুলোরও নজর আছে।
দীর্ঘ মেয়াদে এলএনজি আমদানির জন্য কাতারের সঙ্গে ১৫ বছরের চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৭ সালে হওয়া ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০৩২ সালে। কাতারের রাশ লাফান লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস কম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে করা চুক্তির আওতায় পাঁচ বছর ধরে কাতার থেকে এলএনজি আনা হয়েছে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব হোসেন, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসানসহ একটি প্রতিনিধিদল কাতার সফর করে। এলএনজির বৈশ্বিক তীব্র চাহিদার মধ্যেও বাংলাদেশকে বাড়তি এলএনজি সরবরাহ করার আশ্বাস দিয়েছে দেশটি।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, ‘কাতার আমাদের বাড়তি এলএনজি সরবরাহের ব্যাপারে নীতিগতভাবে সম্মতি দিয়েছে। তবে তারা আমাদের কী পরিমাণ দিতে পারবে, সে বিষয়ে এখনই কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। আমরা আশা করছি, প্রায় দুই এমপিটিএ পাব।’
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, ‘কাতার অতিরিক্ত এই এলএনজি আমাদের কী দামে দেবে, চুক্তি কত বছর মেয়াদি হবে, তা নিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা হবে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এলএনজির চাহিদা এবং ঊর্ধ্বমুখী দামের মধ্যেও কাতার আমাদের সর্বোচ্চ পরিমাণে সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। ’
দেশের এলএনজি টার্মিনালের সক্ষমতা নিয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনালে (এফএসআরও) দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট রাখার সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু আমরা নিচ্ছি প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এখানে প্রতিদিন আরো প্রায় ৪০০ থেকে ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আনা সম্ভব। তাই কাতার থেকে আরো দুই এমপিটিএ যুক্ত হলে সমস্যা হবে না। মহেশখালীতে নতুন করে আরেকটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল করার পরিকল্পনা রয়েছে, সেটি হয়ে গেলে সক্ষমতা আরো বাড়বে। ’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা দেখা যায়। এলএনজির দামও ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে স্পট মার্কেটে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) এলএনজির দাম ৭০ ডলারের ওপর উঠে যায়, যা চলতি বছরের মে মাসেও স্পট মার্কেটে ছিল ২১ ডলার। বর্তমানে স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ৪০ থেকে ৫০ ডলারে ওঠানামা করছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ এখন কাতার ও ওমান থেকে যে এলএনজি পায়, তার প্রতি এমএমবিটিইউর দাম গড়ে ১৫ ডলারের মতো পড়ে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যমান সরবরাহের বাইরে কাতার থেকে অতিরিক্ত এলএনজি আমদানির প্রস্তাব গত মার্চেও একবার দিয়েছিল বাংলাদেশ। তখন বাংলাদেশের গ্যাসসংকটের বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য জানতে চেয়েছিল কাতার। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশের গ্যাস সরবরাহ ও সংকটের হালনাগাদ তথ্য জানিয়ে দ্বিতীয় দফায় কাতারের কাছে বাড়তি এলএনজি চায় সরকার। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এটাই চেয়েছিলাম। এলএনজি যেহেতু আনতেই হবে, তা যেন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে আনা হয়। বর্তমানে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম অনেক বেশি। তাই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির এই তথ্য দেশের জন্য খুবই স্বস্তির খবর। ’ তিনি বলেন, ওমান থেকেও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে কিভাবে বাড়তি এলএনজি কেনা যায়, সে চেষ্টাও এখন থেকেই চালিয়ে যেতে হবে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক প্রায় তিন হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। স্বাভাবিক সময়ে স্পট মার্কেট এলএনজিসহ গড়ে দৈনিক তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যেত। এখন দুই হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে দেশীয় কূপ থেকে আসছে দুই হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে কাতার ও ওমান থেকে আসছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি।