সেই কিশোরেরা স্বাভাবিক জীবনে

সেই কিশোরেরা স্বাভাবিক জীবনে

সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা: কারও জন্য ‘সাজা’ ছিল প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ করা, কারও জন্য ছিল গাছ লাগানো। কাউকে বলা হয়েছিল মাদক থেকে দূরে থাকতে, কাউকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বই পড়তে। আদালতের এমন সব শর্ত মেনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে যাওয়া শিশু-কিশোরেরা।

এদের মধ্যে এক কিশোরের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী কাইয়ারগাঁও গ্রামে। জেলা শহর থেকে ওই গ্রামের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটারের মতো। গত ৩ আগস্ট কাইয়ারগাঁও গ্রামে গিয়ে কথা হয় ওই কিশোর ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।

কিশোরটি জানায়, সে আদালতের নির্দেশে প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ করার চেষ্টা করে, বই পড়ে এবং বাবা-মায়ের কথা অমান্য করে না। আদালতের নির্দেশে নিজের করা ভালো কাজগুলো ডায়েরিতে লিখেও রাখে। ছেলেটির চলাফেরা ভালো। মামলায় জড়িয়ে তার লেখাপড়ার ক্ষতি হয়েছিল।

কিশোরটির বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, তাদের ঘর টিনের ছাউনির। তার বাবা কৃষক এবং বড় ভাই ছোট একটি মুদি দোকান চালান। ঘরে ঢোকার পর কিশোরটি তার ডায়েরি নিয়ে এল, যেটি আদালত থেকে দেওয়া হয়েছিল। ঘেঁটে দেখা গেল, ডায়েরির ৩২টি পৃষ্ঠায় তার ভালো কাজের কথা লেখা।

কী কী ভালো কাজ? কিশোরটি লিখেছে, ‘আমার পাশের বাড়ির একটি ছেলে গাছ থেকে পড়ে বুকে অনেক আঘাত পেয়েছে। তারপর আমি তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছি। তাতে তার বাবা-মা অনেক খুশি হয়েছে।’

নদীর তীরে বালু রাখা নিয়ে গ্রামে মারামারির একটি মামলায় কিশোরটিকে আইনের আওতায় আনা হয়েছিল। গতবছরের অক্টোবরে আদালত তাকে ভালো কাজের শর্তে প্রবেশনে (অবেক্ষাধীন) বাড়িতে থাকার সুযোগ দেন। আগামী মাসে তার পরীক্ষাধীন থাকার মেয়াদ শেষ হবে। সে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। ‘মারামারিতো সবাই করে না। এসব ছেলেকে মামলায় জড়ানোর উদ্দেশ্য হলো হয়রানি করা।’

কিশোরটি যে বিদ্যালয়ের ছাত্র সেই নারায়ণতলা মিশন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহ আলম বলেন, ছেলেটির চলাফেরা ভালো। মামলায় জড়িয়ে তার লেখাপড়ার ক্ষতি হয়েছিল।

ব্যতিক্রমী রায়ের মাধ্যমে এই কিশোরকে বাড়িতে থেকে সংশোধনের সুযোগ দিয়েছিলেন সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জাকির হোসেন। তিনি ২০২০ সালের ১৪ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ১৯৬টি মামলায় ২৬৮ শিশু-কিশোরকে বাড়িতে থেকে সংশোধনের সুযোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ গত ২০ জুলাই ৫২টি মামলার রায়ে ৬৫ শিশু-কিশোরকে সাজা হিসেবে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর পরিবর্তে তাদের জাতীয় পতাকা, ডায়েরি, বই ও ফুল দিয়ে বাড়িতে পাঠানো হয়। তবে শর্ত দেওয়া হয় ভালো কাজের।

‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬০’-এর আওতায় দেওয়া এ ধরনের আদেশ পরিচিতি পায় ‘ব্যতিক্রমী রায়’ হিসেবে। উল্লেখ্য, এই আইন অনুযায়ী, আগে দণ্ডিত হওয়ার কোনো প্রমাণ না থাকা এবং অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে আদালত আসামিকে শর্তসাপেক্ষে বাড়িতে থেকে সংশোধনের সুযোগ (প্রবেশন) দিতে পারবেন। এক্ষেত্রে অপরাধীর বয়স, চরিত্র, শারীরিক বা মানসিক অবস্থা, অপরাধের প্রকৃতি বা অপরাধ সংঘটনে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।

৬২ শিশু মুক্ত

আদালতের প্রশাসনিক শাখার তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৫১টি মামলায় ৬২ শিশু-কিশোর আদালতের শর্ত মেনে মামলা থেকে মুক্ত হয়েছে। অন্যদের অবেক্ষাকাল (প্রবেশন) চলমান। শর্তপালনে ব্যর্থ হওয়ায় তিনটি মামলায় সাত কিশোরকে গাজীপুরের কিশোর সংশোধনাগারে যেতে হয়েছে। তারা সংশোধনাগারে থাকার মেয়াদ শেষে বাড়িতে এসে শর্তপালনের চেষ্টা করছে।

সুনামগঞ্জ শিশু আদালতের বিচারক মামলার রায়ে আদালত যেসব শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে মা-বাবার সেবাযত্ন করা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা, অসৎসঙ্গ ত্যাগ করা, মাদক মুক্ত থাকা, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই পড়া, গাছ লাগানো ও পরিচর্যা করা এবং নতুন করে আর অপরাধে না জড়ানো।

আদালতের শর্তগুলো শিশুদের ঠিকভাবে পালনের বিষয়টি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব সুনামগঞ্জ জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা শাহ মো. শফিউর রহমানের। তিনি বলেন, তিনি সরেজমিনে গিয়ে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুঠোফোনে খোঁজখবর নেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তত্ত্বাবধান করছি। পাশাপাশি অভিভাবকদেরও দায়িত্ব রয়েছে এসব শর্তপালনে শিশুদের সহযোগিতা করা, পাশে থাকা। অনেক অভিভাবকই সেটা করছেন।’

ডায়েরির পাতায় ‘ভালো’ কাজ

মামলার তথ্যবিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মারামারি, চুরিসহ লঘু অপরাধের অভিযোগে বড়দের সঙ্গে এসব শিশুকে মামলায় জড়ানো হয়েছিল। যাদের অনেকেই শিক্ষার্থী। কেউ কেউ অন্য কাজও করে। আদালতে হাজিরায় আসা-যাওয়ায় লেখাপড়ার ক্ষতি, অর্থ ও সময় ব্যয়সহ ছিল নানা ভোগান্তি। ব্যাহত হচ্ছিল স্বাভাবিক জীবন।

এই প্রতিবেদক অবেক্ষাধীন থাকা সুনামগঞ্জের চারটি উপজেলার ২৮ শিশু-কিশোর, তাদের অভিভাবক ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে সরেজমিনে ও মুঠোফোনে কথা বলেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, শিশু-কিশোরেরা আদালতের শর্ত মানছে।

সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রামের কিশোর মো. আরিফুল (ছদ্মনাম) একটি মামলায় আদালতের শর্ত মেনে বাড়িতে থাকার সুযোগ পায়। তার ডায়েরি ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ২ ডিসেম্বর সে লিখেছে, ‘মামলার আসামি হওয়ার পর পড়ালেখাসহ যাবতীয় কাজে আমার ব্যাঘাত ঘটছিল।

আমাকে আমার ভুলশোধরানোর সুযোগ দেওয়ায় অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। মহামান্য আদালতের দেওয়া সব শর্ত আমি মেনে চলব।’ ডায়েরিতে আরও লেখা, সড়কে ধুলার ভোগান্তি থেকে পথচারীদের রক্ষা করতে সে গত ১২ ডিসেম্বর পানি ছিটিয়েছে। বাবা-মায়ের কথা অনুযায়ী নলকূপ থেকে পানি এনে দিয়েছে।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী কাইয়ারগাঁও গ্রামের আরেক কিশোর তার ডায়েরিতে চলতি বছরের ৩ মার্চ লিখেছে, ‘আমি আমার বাগানের পাশে গাছ লাগাইছি। পরিবেশ রক্ষায় আমি সবসময় গাছপালা লাগাই, তাতে আমাদের উন্নতি হবে।’

দিরাই উপজেলার একটি গ্রামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারির ঘটনায় হওয়া মামলায় চার কিশোরকে আসামি করা হয়েছিল। অবেক্ষাকাল চলার মধ্যেই তিনজন এবার এইচএসসি পাস করেছেন। গত ১৫ আগস্ট গ্রামে গিয়ে তাঁদের দুজন ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়। এই দুজন বলেন, তাঁরা অবেক্ষাধীন থাকার শর্তগুলো মানছেন। ডায়েরি লিখছেন।

একজনের মা বলেন, ‘সবসময় ছেলেকে ভালোভাবে চলাফেরা করতে বলি। চোখে চোখে রাখি। আর কোনো ঝামেলায় জড়াতে দেব না।’

মামলায় জড়ানো কিশোরেরা আসলেই ভালো কাজ করছে কিনা, নতুন করে কোনো অপরাধে জড়িয়েছে কিনা, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল ওই গ«ামের বাসিন্দা ফয়সল চৌধুরীকে। তিনি বলেন, ‘মারামারিতো সবাই করে না। এসব  ছেলেকে মামলায় জড়ানোর উদ্দেশ্য হলো হয়রানি করা।’

দিরাই উপজেলার রাজনাও গ্রামের এক পরিবারের চার শিশুকে আরেকটি মারামারির মামলায় আসামি করা হয়। এর মধ্যে দুজন স্কুল ছাত্র। পরিবারের এক পুর“ষ সদস্য বলেন, দুই পরিবারের মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়। পরে প্রতিপক্ষের লোকজন তাঁদের ১২ জনের বির“দ্ধে মামলা দেয়। এর মধ্যে আসামির তালিকায় তাঁর এক ছেলে ও তিন ভাতিজার নাম ছিল।

দুই বছর আগে সুনামগঞ্জ পৌরশহরের একটি মহল্লার তিন শিশুকে একটি চুরির মামলায় গে্রপ্তার করে পুলিশ। পরে তারা ১৮ দিন গাজীপুরের কিশোর সংশোধনাগারে ছিল। এই মামলায় চার শিশু এক বছরের অবেক্ষাধীন শেষে এখন মুক্ত। এদের একজনের বাবা অটোরিকশা চালান।

টানা পোড়েনের সংসার। তাই ছেলে এখন শহরের একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করে। ওই দোকানে গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। ছেলেটি জানায়, এখন সে আর ‘বদ’ ছেলেদের সঙ্গে মেশে না। মা-বাবার কথা শোনে। আরেকজন জানায়, আদালত তাদের সংশোধনের সুযোগ দিয়েছেন। এতেই খুশি। আর কোনোদিন মন্দ কাজ করবে না।

‘এটা উদাহরণ’

শিশু-কিশোরদের সংশোধনাগারে না পাঠিয়ে বাড়িতে থেকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া নিয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল সুনামগঞ্জে শিশু আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হাসান মাহবুব ও জেলার সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি আইনুল ইসলামের কাছে।

হাসান মাহবুব বলেন, জীবনের শুর“তেই শিশুদের ওপর যাতে শাস্তির কালিমা না পড়ে, সেজন্য আদালত তাদের বাড়িতে থাকার সুযোগ দিয়েছেন।

অন্যদিকে আইনুল ইসলাম বলেন, ‘শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য বিচারক আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের সংশোধনের সুযোগ দিয়েছেন। আমরা এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। এই রায় উদাহরণ তৈরি করেছে।’

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *