এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন: বিশ্ব সংস্কৃতির চারণভূমি

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন: বিশ্ব সংস্কৃতির চারণভূমি

চট্টগ্রাম সংবাদদাতা: চট্টগ্রাম নগরীর মাওলানা মোহাম্মদ আলী সড়কে মাত্র কয়েক হাজার বর্গফুট জমির ওপর এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ)-এর অবস্থান। আয়তনে খুবই ছোটো হলেও এই প্রতিষ্ঠানেরই চলছে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। বাইরে থেকে দেখে এর ছিটেফোঁটাও বোঝার উপায় নেই। যেমন পুরো পৃথিবীর সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটেছে বিন্দুর মতো এই ক্যাম্পাসে। ২০০৮ সালে যখন এর যাত্রা শুরু হয়, সেবছর বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ১৩০ জন শিক্ষার্থী ছিল। আজ সেই সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে ইউমেন, ভারত থেকে ভিয়েতনামসহ সবমিলিয়ে ১৯ দেশের শিক্ষার্থীদের কোলাহলে নিত্যদিনে মুখরিত থাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এইউডব্লিউ শিক্ষার্থীরা ৩৫টির বেশি জাতি সত্ত্বার প্রতিনিধিত্ব করে, ২৫টির বেশি ভিন্ন ভাষায় কথা বলে, বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস পোষণ করে এবং বিশ্বকে ভিন্ন চোখে দেখে। সম্প্রদায়গত স্বাতন্ত্র্য এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভিন্নতা থাকলেও এসব শিক্ষাার্থীকে অভিন্ন মূল্যবোধে গ্রথিত করেছে এইউডব্লিউ।

বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদেরকে আন্ডারগ্রেড থেকে গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত শিক্ষাদান করা হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা ১ হাজার ২৩৪ জন। সবচেয়ে বেশি ছাত্রী বাংলাদেশের। এছাড়া উল্লেখ করার মতো শিক্ষার্থী এসেছে আফগানিস্তান, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান, ভারত, পাকিস্তান, সিরিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে।

এছাড়া ইস্ট টিমর, কম্বোডিয়া, লাওস, ইয়েমেন, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও সেনেগালের শিক্ষার্থীও রয়েছে। প্রায় হাজারখানেক শিক্ষার্থী আবাসিক সুবিধা পাচ্ছেন। পাড়ালেখার পাশাপাশি নানা ধরনের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডেও জড়িত শিক্ষার্থীরা। ১২ বছরের অ্যাকাডেমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন শুধু এমন ছাত্রীরাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্য। ভর্তিচ্ছুদের সর্বশেষ পরীক্ষায় সামগ্রিকভাবে গেড় ৬০ শতাংশ নম্বর পেতে হবে। এর মধ্যে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে আলাদাভাবে ৬০ নম্বর পেতে হবে। ভর্তির নিয়মকানুন বিস্তারিত দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইটে। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বসে অনলাইনে আবেদন করা যায়। ভর্তির ক্ষেত্রে প্রার্থীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্জিত ফলাফল, নেতৃত্বের গুণাবলি এবং প্রার্থীর সার্বিক অবস্থা যাচাই করা হয়। পাশাপাশি তার সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম, নিজ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা হয়। প্রাথমিক তালিকায় থাকা আবেদনকারীদের স্থানীয়ভাবে পরিচালিত লিখিত ও মৌখিক সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। ওই পরীক্ষায় প্রার্থীর ইংরেজি ভাষা ও যোগাযোগের দক্ষতা, গণিত ও জটিল সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা যাচাই করা হয়। বর্তমানে মোট শিক্ষার্থীর শতকরা ৮৫ জনই স্কলারশিপ পাচ্ছেন। আবেদন করার পর যাচাই সাপেক্ষে স্কলারশিপের জন্য মনোনীত করা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এশিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ ‘রাষ্ট্রবিহীন’ শিক্ষার্থীদেরও গ্রহণ করে। এসব শিক্ষার্থীর মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রথিতযশা শিক্ষকরা। ৭১ জন শিক্ষকের মধ্যে অনেকেই হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে ডক্টরেট করেছেন।
এইউডব্লিউ বিনির্মাণে সবচেয়ে উজ্জ্বল অবদান রেখেছেন বিশ্বব্যাংক, রকফেলার ফাউণ্ডেশন এবং ইউনিসেফের সাবেক কর্মকর্তা কামাল আহমেদ। এশিয়ায় নারী শিক্ষা ও নেতৃত্বে উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন সাপোর্ট ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট এবং সিইও হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।

ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এই শ্বিবিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন বিজিএমইএ’র সাবেক ও প্রথম নারী সভাপতি রুবানা হক। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি সাবেক উপাচার্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নির্মলা রাওয়ের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। নির্মলা রাও পাঁচ বছর উপাচার্যের দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাষ্টিজ রুবানাকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়। রুবানা পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে পিএইচ.ডি করেছেন। উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ট্রাষ্টি সদস্য ছিলেন। সর্বশেষ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। রুবানা হক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্টার্ন স্কুল অব বিজনেস ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এশিয়া সেন্টারের ভিজিটিং ফেলো। বিবিসির বিশ্বের ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় ২০১৩ ও ২০১৪ সালে টানা দু’বার বাংলাদেশের এই প্রভাবশালী নারী উদোক্তার নাম ছিল। এইউডব্লিউতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি ছাত্রীদের জন্য মেধাবৃত্তি চালুর ঘোষণা দিয়েছেন রুবানা হক। এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি সমমানের পরীক্ষার জিপিএ’র ওপর ভিত্তি করে মেধাবৃত্তি দেওয়া হবে। দুটি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রীরা ৬০ শতাংশ বৃত্তি পাবেন। অর্থাৎ তাকে টিউশন ফি’র মোট ৪০ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *